নাট্যজন কাজী বোরহান: দিনাজপুরের সাংস্কৃতিক বাতিঘর

দিনাজপুরের সাংস্কৃতিক বাতিঘর

নাট্যজন কাজী বোরহান: দিনাজপুরের সাংস্কৃতিক বাতিঘর

চাষা হাবিব

[দায় স্বীকার: কাজী বোরহান চর্চার প্রধান অন্তরায় হলো তাঁর জীবন ও সৃষ্টিকর্মের লিখিতরূপ না থাকা। ফলে পুরো প্রবন্ধটি বিভিন্ন জনের সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে রচিত। যার দরুণ যৌক্তিকতা যাচাইয়ের সুযোগ সীমিত হওয়ায় গবেষণাধর্মী প্রবন্ধের মানকে খানিকটা দূর্বল করেছে। তথাপিও, বিভিন্ন জনের ভাষ্যকে ক্রসকাটিং এর মাধ্যমে নির্মোহ দৃষ্টিতে প্রাসঙ্গিকতাকে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। আশাকরি কাজী বোরহান চর্চায় এটি গুরুত্বপূর্ণ আধেয় হয়ে উঠবে।]

দিনাজপুর—বরেন্দ্রমূখ খ্যাত উত্তরের শান্ত-নিবিড় কৃষিজ জনপদ। এ জনপদের প্রাণকেন্দ্র দিনাজপুর শহরটি শুধু ধান, লিচু কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই পরিচিত নয়, বরং তার গর্ভে লালন করে এমন কিছু প্রতিভা, যাঁরা তাঁদের নিষ্ঠা, মেধা ও মানবিক মননে নির্মাণ করেছেন এক আলোকিত সাংস্কৃতিক পরিম-ল। যা দিনাজপুরকে উদ্ভাসিত করেছে, করেছে আলোকিত। তেমনই এক আলোকবর্তিকা হলেন নাট্যজন কাজী বোরহান-যিনি পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে দিনাজপুরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক অনিবার্য নাম, এক জীবনব্যাপী সংগ্রামের প্রতীক এবং নাট্যভাষ্যে সমাজ-মননের এক সূক্ষ্ম নির্মাতা। দিনাজপুরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে উজ্জ্বল নক্ষত্র কাজী বোরহান নাট্যচর্চা, সংস্কৃতি ও সমাজকল্যাণমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখে হয়ে উঠেছেন এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বাতিঘর। শুধু নাট্যজগতেই নয়, বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামে তার অবদান প্রশংসনীয় ও প্রেরণাদায়ী।

কাজী বোরহান একাধারে কবি, নাট্যশিল্পী, নাট্যকার, নির্দেশক, সংগঠক ও সমাজকর্মী। দিনাজপুর শহরের বিভিন্ন নাট্য সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে তিনি স্থানীয় নাট্যচর্চায় নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছেন। তার নির্দেশনায় মঞ্চস্থ নাটকগুলোতে সমাজ বাস্তবতা, গণচেতনা এবং মানবিক মূল্যবোধের স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায়। তিনি মনে করেন, নাটক শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়—এটি মানুষের চিন্তা, চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলে দেওয়ার এক শক্তিশালী মাধ্যম। তাঁর নেতৃত্বে দিনাজপুরে বিভিন্ন নাট্যোৎসব, কর্মশালা ও পথনাট্য অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা নতুন প্রজন্মকে সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে যুক্ত হতে উৎসাহিত করেছে। বিশেষ করে তরুণ নাট্যকর্মীদের মধ্যে কাজী বোরহানের প্রভাব গভীর ও সুদূরপ্রসারী। তিনি তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, শৃঙ্খলা ও দায়বদ্ধতার বীজ বপন করেছেন।

সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কাজী বোরহান নানা কল্যাণমূলক কাজেও সম্পৃক্ত। নারী অধিকার, পরিবেশ সচেতনতা, শিশু অধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি নাটককে ব্যবহার করেছেন গণসচেতনতা গড়ে তোলার কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে। তার ভাবনা, বক্তব্য ও কাজ সবসময়ই সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের পক্ষে, প্রান্তিক জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে। কাজী বোরহান শুধু একজন নাট্যজন নন; তিনি দিনাজপুরের সংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধেরও প্রতীক। অক্লান্ত শ্রম, একাগ্রতা ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন—নাটক শুধু মঞ্চে নয়, জীবনের প্রতিটি পরতে ছড়িয়ে থাকা এক অনিবার্য বাস্তবতা।

ক্যাপ্টেন হুররায় কাজী বোরহান

 

২.

নাট্যচর্চার সূচনা তাঁর শৈশবে, স্কুলজীবনের প্রাথমিক মঞ্চায়নের মাধ্যমে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেটি হয়ে ওঠে কেবল শখ নয়, বরং এক অন্তর্জাগতিক তাড়না। কাজী বোরহান বিশ্বাস করতেন—নাটক কেবল বিনোদনের এক পন্থা নয়; বরং এটি সমাজ-সংলাপের এক শক্তিশালী ভাষা, যেখানে মানুষ তার নিজস্ব দ্বন্দ্ব, প্রতিবাদ, স্বপ্ন ও স্বর প্রকাশ করতে পারে। এই বিশ্বাস থেকে তিনি নাটককে আত্মস্থ করেছেন দায়িত্বের সাথে, আদর্শের সাথে। দিনাজপুরের সাংস্কৃতিক পরিম-লে এক উজ্জ্বল ও অবিস্মরণীয় নাম কাজী বোরহান। পাঁচ দশকেরও অধিক সময় ধরে নাট্যচর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকা- ও সমাজসেবামূলক কাজে নিবেদিত থেকে তিনি গড়ে তুলেছেন এক অনন্য সাংস্কৃতিক পথচিত্র—যা আজও প্রেরণা জোগায় নতুন প্রজন্মকে। মঞ্চনাটক থেকে পথনাটক, কর্মশালা থেকে নাট্যোৎসব—সবখানেই তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি দিনাজপুরের সংস্কৃতিচর্চাকে দিয়েছে এক দৃঢ় ভিত ও গতিময়তা।

কাজী বোরহানের নাট্যজীবন জুড়ে রয়েছে বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূমিকা—তিনি নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা, সংগঠক ও নাট্যআন্দোলনের ধারক-বাহক। তাঁর রচিত ও নির্দেশিত নাটকগুলো শুধু দৃশ্য-শ্রব্য অভিজ্ঞতা নয়, বরং সামাজিক বাস্তবতার আয়না। তাঁর নাটকে উঠে এসেছে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়ার প্রত্যয়, নিপীড়িত মানুষের ভাষা, নারীর অধিকার, শিশুর স্বপ্ন এবং শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম।

তাঁর নির্দেশিত উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘অচেনা চিঠি’, ‘চাকর’ এবং ‘মাটির মানুষ’, ‘ভূমিকম্পের পরে’, ‘যদিও সন্ধ্যা’ ‘ক্যাপ্টেন হুররা’ ‘যামিনীর শেষ সংলাপ’, ‘সেনাপতি’, ‘রাতের অতিথি —যেগুলো দিনাজপুরসহ দেশের নানা প্রান্তে প্রশংসিত হয়েছে। মঞ্চে এনে দিয়েছেন জীবনের বাস্তবতা ও সমাজ-সংলাপ এবং নীরিক্ষাধর্মী অনুপ্রাস। তাছাড়া পথনাটকের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নাটকের মধ্য দিয়ে তিনি গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে, স্কুলে-কলেজে ছড়িয়ে দিয়েছেন সচেতনতার বার্তা—নারী নির্যাতন বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে জলবায়ু সংকট কিংবা শিশুশ্রম—সবই উঠে এসেছে তাঁর শিল্পিত নাট্যরূপে। আবার অন্যের নির্দেশনাতেও তিনি মূখ্য ক্রীড়ানড়ক হয়ে নেপথ্যে থেকে সর্বাত্মক পরামর্শক সহায়তা করতেন, যা নবীণ অনেক নাট্যকর্মীকে নাট্যনির্দেশকে পরিণত হতে সহায়তা করেছে—যা ছিল কাজী বোরহানের অনন্য বৈশিষ্ট্য।

একজন সংগঠক হিসেবে কাজী বোরহানের দক্ষতা ও প্রজ্ঞা দিনাজপুরে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভিত্তিকে মজবুত করেছে। তিনি স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের নাট্যদলের সঙ্গে কাজ করেছেন, নতুন নাট্যদলের জন্ম দিয়েছেন, এবং তরুণ নাট্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করেছেন ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব। তাঁর নেতৃত্বে দিনাজপুরে আয়োজিত হয়েছে বহু নাট্যোৎসব, নাট্যশিবির, কর্মশালা ও সাহিত্য উৎসব—যেখানে দেশজুড়ে শিল্প-সাহিত্য ও নাট্যকর্মীর মিলনমেলা ঘটেছে।

তিনি বিশ্বাস করতেন—নাটক চর্চা কেবল শহুরে অভিজাত গ-িতে আবদ্ধ থাকলে তা প্রাণ হারায়। তাই তিনি নাটককে নিয়ে গেছেন প্রান্তিক মানুষের কাছে, যেন তাদের মুখে উঠে আসে তাদের জীবনের গল্প, যেন তারা নিজেরাই হয়ে ওঠে নাটকের মুখপাত্র। পূর্বেই বলেছি তাঁর উদ্যোগে দিনাজপুরে অনুষ্ঠিত হয়েছে অসংখ্য নাট্যোৎসব, নাট্যকর্মশালা এবং সচেতনতামূলক পথনাটক, যা নাট্য আন্দোলনের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনকেও শক্ত ভিত দিয়েছে। বিশেষ করে তরুণ নাট্যকর্মীদের অনুপ্রাণিত করতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁদের মধ্যে তিনি আত্মবিশ্বাস, দায়িত্ববোধ ও নান্দনিক সচেতনতা জাগিয়ে তুলেছেন নিঃশব্দ শ্রমে ও নিবিড় ভালোবাসায়—এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন সামাজিক অনন্য ব্যক্তিত্বে।

কাজী বোরহানের জীবনদর্শন গভীরভাবে মানবিক। তাঁর নাট্যচর্চা ছিল সমাজসেবার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি নাটককে ব্যবহার করেছেন সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে। নারী অধিকার, শিশু অধিকার, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, স্বাস্থ্য সচেতনতা, যৌতুকপ্রথা, পরিবেশ রক্ষা—এসব বিষয় নিয়ে তিনি নাটক নির্মাণ করেছেন, পথনাটক করেছেন, বিতর্ক আয়োজন করেছেন, কর্মশালা চালিয়েছেন। তাঁর এই কর্মকা-ে অংশগ্রহণকারী অগণিত তরুণ আজ সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তিনি নারী নাট্যকর্মীদের উন্নয়নে সবসময় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর দলে কাজ করে অনেক নারী নাট্যশিল্পী এখন ঢাকার প্রগতিশীল থিয়েটারেও কাজ করছেন।

৩.

ব্যক্তিজীবনে কাজী বোরহান ছিলেন নিরহঙ্কার, নির্লোভ এবং দায়িত্বশীল। তিনি নিজেকে কখনো ‘নাট্যব্যক্তিত্ব’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাননি, বরং সবসময় বিশ্বাস করতেন—প্রকৃত শিল্পী কাজ করে যায় নিঃশব্দে, আলোর নিচে নয়, আলো তৈরির পেছনে। তাঁর এই আত্মমগ্নতা, অন্তর্দৃষ্টি ও অধ্যবসায় তাঁকে আলাদা করে দিয়েছে সমসাময়িকদের ভিড়ে।

তাঁর লেখা ডায়েরি, চিঠিপত্র ও বিভিন্ন চর্চাপত্রে পাওয়া যায় একজন অনুসন্ধিৎসু, চিন্তাশীল এবং তীক্ষè বুদ্ধিমত্তার নাট্যচিন্তককে—যিনি সবসময় খুঁজেছেন নাটকের ভেতরের ভাষা, প্রতীকের মানে, দর্শকের সঙ্গে সংলাপের নতুন পন্থা। তিনি একই সংলাপ একাধিক ঢঙ্গে উপস্থাপন করে তাক লাগিয়ে দিতেন। দিনাজপুরের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে কাজী বোরহান কেবল একজন শিল্পী বা কর্মী নন—তিনি এক প্রতিষ্ঠান। তাঁর জীবন ও কাজ নতুন প্রজন্মের নাট্যকর্মীদের জন্য একটি পথনির্দেশনা, একটি আদর্শিক সঞ্চার। তাঁর মত করে জীবনকে নাটকের সঙ্গে মিশিয়ে, সমাজকে নাটকের আয়নায় তুলে ধরার সাহস ও নিষ্ঠা—এমন দৃষ্টান্ত বিরল। যা দিনাজপুরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে শূন্যতায় দীর্ঘদিন হয়তো পোড়াবে। এ ক্ষত পূরণের নয়, এ ক্ষত নিরবে সয়ে যাওয়ার—বেদনার।

নাটকের বাইরেও কাজী বোরহানের পদচারণা ছিল সমাজের নানা প্রান্তে। অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিশু সুরক্ষা, পরিবেশ রক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি নাট্যচর্চাকে করেছেন সচেতনতা গড়ার মাধ্যম। মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো, প্রতিবাদী মনন গড়ে তোলা ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার যে শক্তি নাটকে নিহিত—তিনি সেটিকেই কাজে লাগিয়েছেন এক সমাজসচেতন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে। তিনি প্রমাণ করেছেন—নাটক শুধুই মঞ্চে আলো-ছায়ার খেলা নয়, এটি হতে পারে সমাজের বিবেক, মানুষের অন্তরদৃষ্টি ও মুক্তির কণ্ঠস্বর এবং মঞ্চের আলো-অন্ধকার পেরিয়ে নাটকও হতে পারে জীবনের জ্বলন্ত ভাষ্য-এ কথা বলা নিশ্চয়ই অতুক্তি হয় না।

নিবিষ্টমনে পড়ায়ে কাজী বোরহান

 

কাজী বোরহান কেবল একজন ব্যক্তিনাম নয়—তিনি দিনাজপুরের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক প্রেরণাদায়ী অধ্যায়। তার নিরবিচ্ছিন্ন কর্মযজ্ঞ, সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে স্থান দিয়েছে এই অঞ্চলের সংস্কৃতির বাতিঘর হিসেবে। কাজী বোরহান কেবল নাট্যজন নন—তিনি একযোগে কবি, নাট্যকার, নির্দেশক, সংগঠক এবং একনিষ্ঠ সমাজসেবক। তাঁর নির্দেশনায় মঞ্চস্থ নাটকসমূহে যেমন উঠে আসে সমাজবাস্তবতা, তেমনি দেখা যায় মানবিক বোধ, প্রতিবাদী কণ্ঠ এবং শোষিতের পক্ষে উচ্চারিত সুস্পষ্ট বার্তা। তিনি বিশ্বাস করেন, নাটক বিনোদনের পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী হাতিয়ার। তিনি কবি হিসেবে হয়তো পরিচিত নন, কিন্তু ছাত্র অবস্থা থেকেই তিনি কবিতা লিখতেন, তবে প্রকাশে প্রবলভবে অনুচ্ছুক ছিলেন বলেই আজ তাঁর সেইসব কবিতা আমাদের হাতে নেই। যদিও কিছু কবিতা তখনকার বিভিন্ন সাময়িকী কিংবা বিশেষ দিবস প্রকাশনায় স্থান পায়। তিনি কর্মী মানুষ হিসেবেই নিজেকে ভাবতেন, লিখেছেন অনেক কম, তবে যা লিখেছেন তা ঋদ্ধতায় অনন্য।

৪.

মানুষ নিজেই নিজে অতক্রম করে তেমনি কাজী বোরহান নিজের ছায়াকে অতিক্রম করেই হয়েছেন দিনাজপুরের কিংবদন্তি নাট্যব্যক্তিত্ব। দিনাজপুরের নাট্যজগতের বটবৃক্ষ, আপাদমস্তক সংস্কৃতিনিষ্ঠ, শিশুবান্ধব, সৃজনশীল সংগঠক, শিল্প ও শিল্পীর অনুপ্রেরণা, এবং সামগ্রিক অর্থে দিনাজপুরের সকল স্তরের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক নেতা- কর্মীদের গুরুজন। দিনাজপুর নাট্যসমিতির আজীবন নাট্যাধ্যক্ষ, সর্বজনশ্রদ্ধেয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, নাটকে সামগ্রিক অবদানের জন্য শিল্পকলা পদক প্রাপ্ত কাজী বোরহান বাংলাদেশের নাট্যকিংবদন্তি। প্রচার বিমুখতা এবং নীরবতা অনেক সময়ই তাঁর সঠিক পরিচয় জানার পথে বাধা হয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি অখ- ভারতের বর্ধমান জেলার শাহজাদপুরে জন্মলাভ করলেও দিনাজপুর শহরেই তাঁর পুরো জীবন অতিবাহিত হয়েছে। দিনাজপুর জিলা স্কুল এবং সুরেন্দ্রনাথ কলেজে (দিনাজপুর সরকারি কলেজ) শিক্ষাজীবন ও সাংস্কৃতিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘দিনাজপুর নাট্য সমিতি’র সদস্য এবং পরবর্তীতে নাট্য সমিতির অলংকারিক পদ নাট্যাধ্যক্ষ ছিলেন আমৃত্যু। এছাড়াও ছিলেন দিনাজপুর ইনস্টিটিউটের সভাপতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ১৯৮৪ সালে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিডিআরের গুলিতে নিহত দিনাজপুরের কৃতি সন্তান জাসদ ছাত্রলীগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি শাহজাহান সিরাজের স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠিত শহীদ শাহজাহান সিরাজ স্মৃতি সংসদের সভাপতি। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘নবরূপী সুরবানী সঙ্গীত শিক্ষা কেন্দ্র’র প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম সাধারণ সম্পাদক। তাছাড়া দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী প্রায় প্রতিটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ‘গোড়ায় গলদ’ নাটকে (সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ছাত্র থাকাকালে) প্রথম অভিনয় করেই তিনি আলোচনায় আসেন। তারপর ‘ভূমিকম্পের পরে’, ‘বন্দীবীর’, ‘পাহাড়ী ফুল’, যদিও সন্ধ্যা’ তাঁর নির্দেশিত ও অভিনীত নাটকগুলি তাঁকে খ্যাতির চূড়ায় আসীন করে।

কাজী বোরহানের পরিবার

 

নাট্যচর্চায় অবদানের জন্য কাজী বোরহান দিনাজপুর নাট্য সমিতি কর্তৃক নাট্যপরিচালক পদক-১৯৭৩, বিশ্বশান্তি স্মারক সম্মাননা-২০০৩, বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থা সম্মাননা-২০০৩, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার সম্মাননা-২০০৪ এবং বাংলা একাডেমি সম্মাননা-২০১২, জেলা শিল্পকলা দিনাজপুর কতৃক নাট্যকলা পদক-২০১৩, নজরুল স্মৃতি সাহিত্য পদক-২০১৩, নবরূপী সম্মাননা-২০১৪, নটবর পরেশ মেলা সম্মাননা-২০১৪, দৈনিক তিস্তার রজত জয়ন্তীতে বিশেষ সম্মনা-২০১৪, বাংলাদেশ শিল্পকলা পদক-২০১৫, সুইহারী সংগীত নিকেতন গুণীজন সম্বর্ধনা-২০১৬, উদীচি দিনাজপুর জেলা সম্মাননা- ২০১৬, অগ্নিলা নৃত্য নিকেতন আজীবন সম্মাননা-২০১৬, শিল্পকলায় অবদানের জন্য লাল সবুজ বাংলাদেশ সম্মানান-২০১৬, দিনাজপুরের নাট্য এবং সাংস্কৃতিতে ভুমিকা রাখার জন্য দিনাজপুর জেলা সমিতি ঢাকা সম্মাননা-২০১৭, এটিএন বাংলা আজীবন সম্মাননা-২০১৮, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সম্মাননা-২০১৮, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য এমবিএসকে এবং পিকেএসএফ কর্তৃক গূণীজন সম্মাননা-২০১২, দিনাজপুর ইনস্টিটিউট সম্মাননা স্মারক-২০২৩, নাট্য সমিতি সম্মাননা-২০২৩ স্মারকসহ অনেক পদক-পুরস্কার-সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

নাট্যধাক্ষ কাজী বোরহানের হাতে গড়া শিক্ষার্থী, নাট্য সমিতির বর্তমান নাট্যধাক্ষ গুরুর যোগ্য শিক্ষার্থী নাট্যজন কবি তরিকুল আলম তাঁর ‘গুরুদক্ষিণা’ কবিতায় লেখেন-

পৃথিবী থেকে ১৩ লক্ষ গুণ বড়ো তোমার মাথাটি

           যেখানে অষ্টপ্রহর মঙ্গল বারতা চাষ করো;

রোদের পেলব চুম্বন, সোহাগি জ্যোৎস্নার

জ্যোতির্ময় কিরীট তোমার ওই মস্তক-

                                  কাজী সাহেব, কতো দাম?

(গুরুদক্ষিণা/ তরিকুল আলম)

এই কবিতায় কাজী বোরহানের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য চমৎকারিত্বের সহিত কাব্যময়তায় উদ্ভাসিত, যা কবির গুরুদক্ষিণাকে সার্থক করেছে। দাম কত কথাটির মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পাই অমূল্য রতেœর কাজী বোরহানকে। তিনি নিজেই যেন একটি ইনস্টিটিউট, আপার মমতায় তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদেরকে তৈরি করেছেন। কবি বলেন-

ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আলোকিত করা অন্তর্ভেদী

                          তোমার চোখ জোড়া

বিশ্বকর্মার বিস্ময় সৃষ্টি নীলাভ জোড়া বিশ্বজিৎ

যা’ দিয়ে তুমি স্বপ্নের সিঁড়ি দেখো;

মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছুঁড়ে দাও স্বপ্ন-শেল,

                           কাজী সাহেব, কতো দাম?

(গুরুদক্ষিণা/ তরিকুল আলম)

কাজী বোরহান নাট্য সমিতিতে কিংবা ‘মৈত্রী’ বুক স্টোরে যখন বসতেন তখন তিনি কিছু না কিছু লিখতেন, তাঁর হাতের লেখাও চমৎকার ছিল। পরম মমতায় সমিতির যাবতীয় বিষযাবলী নথি করে রাখতেন। কি লিখতেন সেসব হয়তো আজ আর পাওয়ার সুযোগ নেই, সেই আক্ষেপেও যেন কবি বলে চলেন-

তোমার তিন আঙুলে ধরা অতি ক্ষুদ্র ক্ষুরধার মসি

যেখান থেকে চিত্রিত হয়েছে সাম্য সমাজ

ঝরেছে ভবিষ্যৎ আলো করা অমোঘ বাণী;

                        কাজী সাহেব, কতো দাম?

    (গুরুদক্ষিণা/ তরিকুল আলম)

তাঁর পুরোনাম কাজী বোরহান উদ্দীন। পিতা কাজী আব্দুর রহমান। মাতা মাকসুদা খাতুন। জন্ম ২৮ মে, ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ। জন্মস্থান সাহাজাদপুর, থানা মেমারী, মহকুমা কান্না, জেলা বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। বাবার মৃত্যুর পর ছোট চাচা কাজী আব্দুর সাত্তার বর্তমান বাংলাদেশের দিনাজপুর শহরের মুন্সিপাড়ায় তাঁর নিজ বাসায় কাজী বোরহানকে নিয়ে আসেন এবং গোলাপবাগ জুনিয়র মাদ্রাসায় ১ম শ্রেণিতে ভর্তি করান। সেখানে তিনি ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যায়ন করেন। দিনাজপুর জিলা স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ না থাকায় পুনরায় ৫ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ১৯৫৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৬০ সালে বাণিজ্য বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। নিজ গ্রাম চকশিবপুর (বাজনাহার) কামাতবাড়ি বিরল দিনাজপুরে ছিল তাঁর কৃষিকাজের ক্ষেত্র। নিজ হাতে হাল বাওয়া, ধান রোপণ সব করতেন পরম মমতায়। নিজ এলাকায় প্রথম আধুনিক পদ্ধতিতে আখ রোপণ, রাসায়নিক সার প্রয়োগ, কীটনাশক ব্যবহার শুরু করেন তিনি। কৃষি কাজ করে ট্রেনে দিনাজপুর শহরে কলেজ যাওয়া-আসার সমস্যার কারণে তাঁর শিক্ষাজীবনে বিরতি ঘটে।

নাটকে কাজী বোরহান

 

দিনাজপুর জিলা স্কুলে পড়াকালীন সময়েই তাঁর সাংস্কৃতিক মেধার প্রকাশ ঘটে—জাতীয় ও বিশেষ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি, ধারাভাষ্য প্রদান এবং শিক্ষকদের রচিত নাটকে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি শিক্ষক ও দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। শিক্ষক গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য (পন্ডিত স্যার) ও তাজমিলুর রহমান তাঁর নাট্যজীবনের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেন। বিশেষত পন্ডিত স্যারের অনুপ্রেরণা ও সহায়তা ছাড়া নাটকের প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মাত না বলেই তিনি এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন।

খেলাধুলার প্রতি ছিল প্রবল আকর্ষণ—বেসবল, বাস্কেটবল, হাডুডু থেকে শুরু করে ব্যাডমিন্টন, খেলার সময় হুঁশ থাকত না। স্কুল ছুটি মানেই খেলার মাঠে ছোটা। স্কুল ছুটির ঘণ্টা কখন বাজবে—এই প্রতীক্ষায় থাকতেন সদা বিভোর। নাটক আর খেলাধুলা—এই দুটোই ছিল তাঁর জীবনের প্রধান সখ। সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়াকালীন বার্ষিক নাট্যপ্রযোজনা ‘গোড়ায় গলদ’ নাটকে অভিনয় করে তিনি প্রথমবারের মতো মঞ্চে আলোড়ন তোলেন এবং প্রশংসা অর্জন করেন। যদিও নাটকের প্রতি তাঁর অনুরাগের সূত্রপাত হয় স্কুল জীবনেই, কলেজ মঞ্চে তাঁর অভিনয়-প্রতিভার বিস্ফোরণ ঘটে এই নাটকের মাধ্যমে। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে একজন পূর্ণাঙ্গ নাট্যকর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক হয় বলে তিনি সাক্ষাৎকারে জানান।

শৈশব থেকেই বইপড়া তাঁর বড় নেশা। বইমেলা মানেই ছুটে যাওয়া, বিশেষ করে ঢাকায় বাংলা একাডেমির বইমেলায় তিনি নিয়মিত বই কিনতেন। দিনাজপুরে ‘মৈত্রী নামে একটি বইয়ের দোকান খোলেন বইয়ের মাঝে ডুবে থাকার ইচ্ছায়, ব্যবসার জন্য নয়। তরুণদের বই পড়ায় আগ্রহী করতে পত্র-পত্রিকারও আয়োজন ছিল সেখানে—দেশ, থিয়েটার’, ‘বিচিত্রা’, ‘রোববার’ ‘সানন্দা’, ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’ ‘শৈলী’, ‘অনন্যা সহ সমকালীন নানা সাময়িকী। ‘মৈত্রী হয়ে ওঠে জ্ঞানপিপাসুদের আড্ডাস্থল। দিনাজপুরে তখনো পত্রিকার নিয়মিত এজেন্সি চালু হয়নি, কিন্তু ‘মৈত্রীর সৌজন্যে পাঠক পেতেন সেইসব পত্রিকা। এমনকি পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও গ্রাহকদের বাসায় তিনি নিজে সাইকেলে করে পত্রিকা পৌঁছে দিতেন।

তিনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের দিনাজপুর অঞ্চলের স্কুল কার্যক্রমে সক্রিয় ছিলেন—বই বিতরণ, পাঠ অভ্যাস গড়ে তোলা, কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। পাশাপাশি ‘হেমায়েত আলী হল ও লাইব্রেরি’ গঠনে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শিশু প্রতিযোগিতা ও শিক্ষা সপ্তাহে বিচারক হিসেবে অংশ নিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন শিক্ষার্থীদের কাছে প্রিয় এক মানুষ, প্রিয় স্যার। তিনি ছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর দিনাজপুরের এক আলোকবর্তিকা।

৫.

বাংলাদেশ জন্মের সাথে জড়িত সকল আন্দোলনেই তিনি জড়িত ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তিনি। ভাষা আন্দোলনের সময় দিনাজপুর জিলা স্কুলে পড়াকালীন বন্ধুদের সঙ্গে মিছিলে অংশ নিতে শিক্ষকদের নিষেধও উপেক্ষা করেছেন—বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল দৃঢ় ও সংগ্রামী। ভাষাসৈনিক হয়েও তিনি কখনো এর সুফল নেওয়ার চেষ্টা করেননি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। স্বাধীনতার পর প্রথম বিজয় দিবস উদ্যাপন ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম আনন্দময় স্মৃতি। তাঁর সহযোদ্ধারা অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিলেও তিনি মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নেননি, নেননি কোন সুযোগ-সুবিধা। বাম-রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকা- ছিল তাঁর জীবনের গভীর বেদনার মুহূর্ত- একথা অকপটেই স্বীকার করেন কাজী বোরহান। পরে ন্যাপ-পিকিংপন্থী মতাদর্শের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন আজীবন। কখনো রাজনৈতিক আদর্শের স্খলন তাঁর জীবনে ছিল না, ফলে সকল মতের, সকল দলের কাছেই ছিলেন গ্রহনীয় ও পূজনীয় ব্যক্তিত্ব।

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও তিনি ছিলেন অগ্রগামী। ছাত্রনেতা ও দিনাজপুরের মেধাবী ছাত্র শাহজাহান সিরাজ হত্যার প্রতিবাদে ‘শাহজাহান সিরাজ স্মৃতি সংসদ’ গঠন করেন এবং এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। সাংস্কৃতিক প্রতিবাদের মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন আজীবন। সকল ভালোর সাথে থেকেছেন সামনের সারিতে।

কাজী বোরহান ছিলেন ধর্মপ্রাণ ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার এক বিরল উদাহরণ। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘ধর্ম ও সংস্কৃতি পরস্পরের পরিপূরক—এই দুইয়ের সংযুক্তিতেই মানুষের অন্তর নির্মল হয়, অন্যায়ের সঙ্গে আপস করা সম্ভব হয় না।’ শৈশবে মাদ্রাসায় পড়াশোনার সময় থেকেই নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন, যা আমৃত্যু পালন করে গেছেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, নাটক, শিল্প ও সংস্কৃতির শিকড়ও ধর্মীয় মূল্যবোধেই প্রোথিত। ধর্মের নামে সংস্কৃতির দমন বা সংস্কৃতির নামে ধর্মবিরোধিতা তাঁকে ব্যথিত করত। তিনি জীবনভর চেষ্টা করেছেন এই দুইয়ের মধ্যে সেতুবন্ধ গড়তে—একটি সৎ ও মানবিক সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে তাঁর নাট্যচর্চা কখনো ধর্মবোধের বিরোধিতা করেনি, বরং তা ছিল একে অপরের পরিপূরক। তাঁর জীবনযাপনই আমাদের কাছে এক অনন্য আদর্শ।

৬.

১৯৬৮ সালের ১৯ নভেম্বর কাজী বোরহান বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ক্ষেত্রীপাড়ার শাহ মাহবুব আহম্মেদ ও হাসিবা খাতুনের কন্যা কাজী তাহেরা আহমেদের সঙ্গে। তাঁদের চার সন্তান—তিন কন্যা ও এক পুত্র। একমাত্র পুত্র শান্ত মাত্র ১৩ মাস বয়সে মৃত্যুবরণ করলেও, সেই শোক তিনি আজীবন মনের গভীরে লুকিয়ে রেখেছেন। কখনো কাউকে বুঝতে কিংবা জানতেও দেননি। তাঁর তিন কন্যা নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। ব্যক্তিগত জীবনে কাজী বোরহান ছিলেন নিরহংকার, পরিশ্রমী ও মানবসেবায় নিবেদিত। প্রায় ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত নিজেই সাইকেল চালিয়ে দিনাজপুর থেকে গ্রামের বাড়ি বিরলের বাজনাহারের শিবপুর-দূর্গাডাঙায় যাতায়াত করতেন। পারিবারিকভাবে হোমিওপ্যাথি জানতেন এবং নিঃস্বার্থভাবে চিকিৎসাসেবা দিতেন। মানুষের যেকোনো ডাকে সাড়া দিতেন নির্দ্বিধায়।

তিনি ভালোবাসতেন ছবি তোলা, ভ্রমণ, কৃষিকাজ ও বিশেষভাবে ফুলের বাগান করতে। কালী মন্দিরের পাশে তাঁর গোলাপ ও মৌসুমি ফুলের বাগান ছিল একটি নিঃশব্দ সৌন্দযের্র কেন্দ্র। মানুষের কল্যাণে তাঁর অবদান ছিল নিঃস্বার্থ ও গভীর। দূর্গাডাঙার দুই বিঘা জমি তিনি আমৃত্যু বিক্রি করেননি, শুধুমাত্র একজন ভাগচাষী পরিবার যেন বিপদে না পড়ে—এই মানবিক দায়বোধ থেকেই। ভালোবাসতেন মানুষের জন্য কিছু করতে। দূর্গাডাঙায় তাঁর অনেক জমি-জিরাত ছিল। সময়ের প্রয়োজনে জমির প্রায় সবটুকুই বিক্রি করেছিলেন। শুধু বিক্রি করেননি দুই বিঘা জমি। সেই দুই বিঘা জমির আঁধিয়ার ছিল তালপুকুরের সুরেশ্বর রায়, সুরেশ্বর তার স্ত্রী পুত্রদের ভরণপোষণের জন্য আঁধি করত সেই জমি। এ জমি বেঁচে দিলে সুরেশ্বরের বিপদ হবে তাই তিনি সেই জমি বিক্রি করেননি আমৃত্যু। সুরেশ্বরের ছেলেরা তাকে কাজী দাদু বলে ডাকতো। আশির দশকে ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কৃষকদের জন্য শ্যালো পাম্প কিনেছিলেন। নিজের প্রয়োজনের চেয়ে অন্যের উপকারই ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র।

কাজী বোরহান ছিলেন আজীবন শিশুপ্রেমী ও সাংগঠনিক চেতনায় উজ্জ্বীবিত এক মানবদর্শী। তাঁর বিশ্বাস ছিল, ‘শিশুরা আগামী দিনের স্বপ্নদ্রষ্টা—তাদের সঠিকভাবে গড়ে তোলাই সমাজ গঠনের প্রধান কাজ।’ নারী-পুরুষের সমঅংশগ্রহণে সমাজ গঠনের পক্ষেও তিনি ছিলেন শক্ত অবস্থানে, বিশেষ করে নারীদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করতে কাজ করেছেন।

ছাত্রজীবনে তিনি ‘ছাত্র ইউনিয়নের মুকুল ফৌজ’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে ছাত্র ইউনিয়নের পিকিংপন্থী ধারায় বাম রাজনীতি করেছেন। আরও পরে ন্যাপ-পিকিংপন্থী, পরবর্তীতে খাজা নাজিমুদ্দিন মুসলিম হল ও লাইব্রেরির (বর্তমানে হেমায়েত আলী পাবলিক লাইব্রেরি) কার্যনির্বাহী সদস্য, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং দিনাজপুর ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

নাট্যজন কাজী বোরহান

 

১৯৬৩ সালের ২ জানুয়ারি, খায়রুল আনাম, মানস কুমার নাথ, আকবর আলী ঝুনুসহ দিনাজপুরের সেইসময়ের উঠতি ও মেধাবী নাটুয়াদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘নবরূপী’। ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। পাশাপাশি, শতবর্ষী ‘দিনাজপুর নাট্য সমিতি’র সঙ্গে সত্তরের দশক থেকে আমৃত্যু নাট্যাধ্যক্ষ হিসেবে যুক্ত ছিলেন। নাটকের বাইরে শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিকভাবে সচেতন করে তুলতেও তিনি কাজ করেছেন এ বিশ্বাস থেকে— ‘যে জাতি সংগঠিত হয়ে সংস্কৃতি ধারণ করতে পারে, সে জাতি কখনোই সহজে বিপথে হারায় না।’

শতবর্ষী দিনাজপুর নাট্য সমিতির প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল নাট্যাধ্যক্ষ হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন কাজী বোরহান উদ্দিন। ষাটের দশকে নাট্যসমিতিতে যুক্ত হয়ে তিনি প্রথাগত ধ্যানধারণার বিপরীতে আধুনিক নাট্যচিন্তা ও প্রয়োগের মাধ্যমে নাট্যচর্চায় নবজাগরণ ঘটান। ১৯৬৩-৬৪ সাল থেকে দিনাজপুরের আরেক কৃতি সন্তান কবি ও সংগঠক মকবুল হোসেন সহ নাট্য সমিতির অন্যান্য নেত্রীবৃন্দের উদ্যোগে বার্ষিক নাট্যোৎসব ও অভিনয় প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন, যা দিনাজপুরসহ বাংলাদেশে নাট্যচর্চার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নাট্য প্রতিষ্ঠান গঠনে উৎসাহ দান করে। পিছিয়ে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে সজীব ও সক্রিয় করে তোলে এবং জনসাধারণকে নাট্যশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট ও অনুরাগী করে তোলে। ১৯৬৪ সাল থেকে আমৃত্যু তিনি সেই উদ্যোগকে জিইয়ে রাখতে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন।

নাট্য নির্দেশনায় তিনি ছিলেন নিপুণ ও দৃঢ়দৃষ্টি সম্পন্ন। প্রায় ২০-২৫টি নাটকে নির্দেশনা দিয়েছেন, যার মধ্যে রতন কুমার ঘোষের ‘ভূমিকম্পের পরে’ তাঁর সর্বোচ্চ কৃতিত্ব হিসেবে বিবেচিত—১৯৭৬ সালে ময়মনসিংহে এই নাটকটি ১১টি বিভাগের মধ্যে ৯টি পুরস্কার অর্জন করে। তিনি প্রায় ৬০-৬৫টি নাটকে অভিনয় করেছেন, শুরু হয় ‘বন্দী বীর’ নাটক দিয়ে। উল্লেখযোগ্য অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘পাহাড়ী ফুল’, ‘যদিও সন্ধ্যা’, ‘এখনো যুদ্ধ’, এবং ‘ক্যাপ্টেন হুররা’, যেটি ১৯৭৭ সালে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্য উৎসবে ‘এ’ক্যাটাগরি অর্জন করে। নাটকের পাশাপাশি সেট নির্মাণ, আবহ সংগীত, লাইটিং, নতুন নতুন প্রপস ব্যবহার, সংলাপে লোকজ ও বহুমাত্রিকতার উপস্থাপন, সবই করতেন নিজ হাতে যেন মুন্সিয়ানায় অনন্য সৃজনীকারিগর।

তিনি শুধু একজন অভিনেতা বা নির্দেশক নন—ছিলেন নাট্যশিক্ষার এক অনানুষ্ঠানিক বাতিঘর। নাট্যজগতের অসংখ্য শিল্পী, কর্মী ও নাট্যপ্রেমীর কাছে তিনি ছিলেন অনুপ্রেরণার উৎস। সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য নাট্যকর্মী, অভিনেতা, অভিনেত্রী, নির্দেশক, নাট্যকার, কারিগরী দক্ষকর্মী ও নাট্যপিপাসু দর্শক। সরাসরি শিক্ষক না হয়েও দিনাজপুরের নাট্যাঙ্গনে তাঁকেই সবাই স্যার বলতেন। ২০২৪ সালের ২৩ জুন, রোববার দুপুর ১২:১৫ টায় দিনাজপুর হারায় এই মহামূল্যবান নাট্যনক্ষত্রকে। নবরূপী গৃহে শেষ শ্রদ্ধা ও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের পর কালিতলার ছানাপীর কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত নাটকের জন্য নিবেদিত ছিলেন তিনি—এ যেন সত্যিকারের নাট্যপ্রেমিকের জীবনরচনার নাট্যরূপ।

শেষকথা: এক জীবন, বহুমাত্রিক দীপ্তি

কাজী বোরহান ছিলেন একাধারে নাট্যশিক্ষক, উচ্চমানের অভিনেতা, আধুনিক কৃষক, ক্রীড়াবিদ, বিশেষ করে নারীদের ক্রীড়ায় যুক্ত করার উদ্যোক্তা, শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রগতিশীল চিন্তানায়ক, প্রাকৃতিক চিকিৎসায় অনুরাগী এবং এক সংগ্রামী মানবিক নেতৃত্বের প্রতীক। তাঁর জীবন বহুমাত্রিক ও দীর্ঘ হলেও তা বড্ড ক্ষণকাল। কৈশোরেই দেশভাগের বেদনা নিয়ে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাড়ি জমান পূর্ব পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চল দিনাজপুরে। স্কুল-কলেজের লেখাপড়া শেষে যুক্ত হন কৃষিতে। এখানেই তাঁর শিকড় গ্রথিত হয় কৃষিজ সংস্কৃতির উর্বর মাটিতে। ষাটের দশকে নাট্যচিন্তায় জাগরণ আনতে যুক্ত হন শতবর্ষী দিনাজপুর নাট্য সমিতিতে, পাশাপাশি নেতৃত্ব দেন নবরূপীর মতো সাংস্কৃতিক সংগঠনে। নাটকের মঞ্চে তিনি যেমন শক্তিশালী শিল্পী, তেমনি অনুশীলনের পরতে পরতে হয়ে উঠেছেন নাট্য শিক্ষক। তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন শাজাহান শাহ, মাজেদ রানা—যাঁরা দিনাজপুরের নাট্যভুবনের উজ্জ্বল নক্ষত্র।

কাজী বোরহান শুধু নাটকে থেমে থাকেননি। সংস্কৃতির অখ-তা রক্ষার ও সংস্কৃতিবিরোধী গোঁড়ামির বিরুদ্ধে যুক্তি ও বিশ্বাসের আলো জ্বালিয়েছেন। পাকিস্তানি শাসনে আবহমান বাংলার সংস্কৃতিকে ভাঙা এবং তথাকথিত ইসলামি তমদ্দুনকে রক্ষার বিরুদ্ধে নবরূপী সৃষ্টির মাধ্যমে লড়াই করেছেন। যে পথ ধরেই মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা আত্মপরিচয়ে শক্তি অর্জন করেছি, পেয়েছি স্বাধীন মাতৃভূমি। মহান মুক্তিযুদ্ধে লড়েছেন সংস্কৃতিযোদ্ধা হিসেবে। ক্রীড়াক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সমাজ-মনস্তত্ত্বেও প্রতিরোধ ভেঙেছেন। ব্যয়বহুল চিকিৎসার বিপরীতে প্রাকৃতিক চিকিৎসা ও হোমিওপ্যাথিকে উৎসাহিত করেছেন। তিনি ছিলেন নিঃস্বার্থ, নির্লোভ, আত্মজয়ী—একজন মানবতাবাদী পথপ্রদর্শক। তিনি শিক্ষক না হয়েও, হয়ে উঠেছেন হাজারো মানুষের ‘স্যার’। এ শিক্ষকদের কোনো পাঠ্যসূচি নেই, সীমানা নেই, তাঁদের ছাত্রদের সংখ্যা গণনায় ধরা যায় না। এ রকম মানুষ বিরল, বর্তমানে তারা আরও বিরল থেকে বিরল হয়ে উঠেছেন।

কাজী বোরহান ছিলেন সেই প্রজন্মের প্রতিনিধি, যাঁরা বিশ্বাস করতেন— ‘প্লেইন লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিং’। তাঁরা চিন্তাকে উৎসর্গ করতেন সমাজ ও দেশের ভবিষ্যতের জন্যে। যেখানে অর্থ, ক্ষমতা আর লুটপাটের আগ্রাসনে প্রতিদিনই রক্তাক্ত হচ্ছে মূল্যবোধ, কাজী বোরহান ছিলেন সেখানে ব্যতিক্রমী নীরব এক পাহারাদার। তাঁর মতো মানুষেরা অস্ত্রের বদলে সংস্কৃতিকে হাতে তুলে নিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে, স্বাধীনতা-পরবর্তী নাট্যচর্চার সূচনা ঢাকা বা কলকাতা দেখে অনুপ্রাণিত। এই ধারণা ভুল প্রমাণ করেছেন কাজী বোরহান, শাজাহান শাহ, মাজেদ রানা প্রমুখ, যাঁরা প্রমাণ করে দিয়েছেন—দিনাজপুরের মাটিতেও শতবর্ষের নাট্যঐতিহ্য ও চিন্তার উত্তরাধিকার বহমান ছিল। কাজী বোরহানের মতো মানুষেরা সমাজের কাছে শুধু গ্রহণযোগ্য নয়, শ্রদ্ধেয় করে তুলেছিলেন- এই আমাদের প্রাপ্তি! তবে কষ্টের জায়গাটি হলো—আমাদের উত্তপুরুষ কাজী বোরহানরা যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, তার কি হবে! হা’ভাতে সংস্কৃতি আর নষ্ট রাজনীতিতে কল্যাণকামিতার যে দূর্যোগ, মূল্যবোধের যে চরম বিপর্যয়, তখন এ প্রশ্ন মনের গহীনে ঘুরপাক খায়—হয়তো সময়েই উত্তম নিরাময়ক,এই যা ভরসা।

জীবনের শেষ অধ্যায়েও তিনি অবলম্বন পেয়েছেন তাঁর পরিবারে—বিশেষ করে মেয়ে কাজী বন্যার স্নেহ, পরিচর্যা, ও সাহচর্য। তাঁর মেয়েরাও তাঁর সাংস্কৃতিক উত্তরসূরি। পরিবারকে গড়ে তুলেছেন সততা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ দিয়ে, এখানেও তিনি আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। শেষ বয়সে বেশকিছু পুরস্কার পেলেও এই মানুষটিকে আমরা হয়তো যথার্থ মূল্যায়ণ করতে পারিনি। কাজী বোরহানকে নিয়ে বহুমাত্রিক মূল্যায়ণ করা উচিত বলে মনে করছি। আমরা কেউ থাকবো না, কিন্তু বৃষ্টির প্রতীক্ষায় যেমন খরার ক্লান্ত মাটি চেয়ে থাকে, তেমনি সমাজও অপেক্ষায় থাকবে নতুন মূল্যবোধের—নতুন বোরহানদের। কাজী বোরহানরা এ সমাজে বড্ড বেশি প্রয়োজন। ক্ষণজন্মা এ সাধককে আজ আর কিছু দেওয়ার নেই। কেবলই বিনম্র শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা আর—লাল সালাম। চাষা’র প্রণতি লও হে দরদিপ্রাণ-

ওপারের গহীন প্রান্তরে জেগে থাকে কি প্রাণ! হয়তো থাকে কিংবা নয়

নাকি অন্ধকার—শুধুই অন্ধকার, নাকি আলোর দিপ্তিতে দিপন শিৎকার

হয়তো বুনো জলের পানাঘরে তুমি থাকো অলক্ষ্যে সেইসব মন্তরে;

যেভাবে ভূমিকম্পের পরে বন্দীবীরও পাহাড়ী ফুল নিয়ে খেলা করে;

আজ নরম ঘাসের পরম¯্রােতে যদিও সন্ধ্যা—তাইতো তোমার পথে

আমরা মাটির মানুষ অপেক্ষায় সেনাপতি কবে আসবে এই মন্বন্তরে;

এখনো যুদ্ধ, এখনো রক্ত, এখানো আলোঘরে কেউটে নাচন তোলে

বিষ নিঃশ্বাসে ক্যাপ্টেন হুররার হুঙ্কার আজ যে বড্ড বেশি প্রয়োজন;

মনে করো—অচেনা চিঠির মতন যামিনীর শেষ সংলাপ চেপেছে বুকে

রাতের অতিথিরা সব গ্রাস করে—এখানে অর্থ, ক্ষমতা আর লুটপাটে

নগ্ন হয় তোমার মনোচর চাকর আগ্রাসনে, অথচ তুমি স্বপ্ন দেখেছিলে

একদিন এই মাঠ, এই তেপান্তর, এই ডুবোজল, নরমঘাস বাতাবিঘ্রাণ

সব আমাদের হবে, হয়নি দরদি-আজ কেবলি শকুনমিছিল কোরাস করে;

                                                       (ওপারে গহনপুর ॥ চাষা হাবিব)

[বি.দ্র. দিনাজপুরের নাট্য কিংবদন্তি কাজী বোরহানকে উৎসর্গীকৃত চাষা হাবিবের কবিতার অংশবিশেষ]

কৃতজ্ঞতা ও পাঠসহায়ক:

  1. সাক্ষাৎকার: রেজাউর রহমান রেজুু, সাধারণ সম্পাদক, দিনাজপুর নাট্য সমিতি, তারিখ: ১০/০৫/২০২৫, নাট্যসমিতি;
  2. সাক্ষাৎকার: তরিকুল ইসলাম, কবি ও নাট্যাধ্যক্ষ, দিনাজপুর নাট্য সমিতি, তারিখ: ১০/০৫/২০২৫, নাট্যসমিতি;
  3. সাক্ষাৎকার:সম্বিত সাহা সেতু, লেখক ও নাট্যকার, নির্দেশক-অভিনেতা; তারিখ: ১০/০৫/২০২৫, নাট্যসমিতি;
  4. সাক্ষাৎকার: কাজী বন্যা, মেয়ে কাজী বোরহান ও সংস্কৃতিকর্মী; তারিখ: ১৪/০৫/২০২৫, নাট্যসমিতি;
  5. সাক্ষাৎকার: সহিদুল ইসলাম, রাজনীতিবিদ ও সদস্য দিনাজপুর নাট্য সমিতি; তারিখ: ০৮/০৫/২০২৫, নাট্যসমিতি;
  6. সাক্ষাৎকার: নুরুল মুতন সৈকত, কবি, সম্পাদকও প্রতিষ্ঠিাতা পরিচালক, মণিমেলা; ০৭/০৫/২০২৫, নাট্যসিমিতি;
  7. সাক্ষাৎকার: নয়ন বার্টেল, নাট্যনির্দেশক ও সংগীত শিল্পী, তারিখ: ১৩/০৫/২০২৫, নাট্যসমিতি;
  8. সাক্ষাৎকার: সুলতান কামাল উদ্দীন বাচ্চু, সভাপতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, দিনাজপুর, তারিখ: ১৫/০৫/২০২৫, নাট্যসমিতি;

চাষা হাবিব

কবি ও গবেষক

সম্পাদক- ‘বাহে সাহিত্যপত্রিকা, দিনাজপুর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button