কড়া: সমতলের বিপন্ন আদিবাসী
বিপন্ন আদিবাসী
কড়া: সমতলের বিপন্ন আদিবাসী
চাষা হাবিব
এ দেশ থেকে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে একটি জাতি। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য আর ধর্ম বিশ্বাসগুলো। দিনাজপুরের একেবারে সীমান্তবর্তী গ্রাম ঝিনাইকুড়িতে এ আদিবাসী পাড়াটির অবস্থান। একসময় এ জাতির হাজার পরিবার বাস করত দিনাজপুর ও রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায়। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় বাঙালিদের দ্বারা এদের পূর্বপুরুষদের ভ‚মি দখল, ভ‚মিকেন্দ্রিক দ্ব›দ্ব ও প্রাণনাশের হুমকি এবং সীমাহীন দারিদ্র্যর কাছে পরাস্ত হতে থাকে কড়া’রা। ফলে প্রায় বাধ্য হয়েই জীবন বাঁচাতে দেশ ছাড়ে তাদের অনেকে। চলে যায় কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে ভারতে। এদেশে কড়া আদিবাসীদের একমাত্র গ্রামটি দিনাজপুরের বিরল উপজেলার হালজায় মৌজায়। এখানে বাস করে ২২টি পরিবার। এছাড়া বৈরাগীপাড়ায় একটি এবং সদর উপজেলার ঘুঘুডাঙার খাড়িপাড়ায় রয়েছে আরো দুটি কড়া পরিবার। কড়াদের দেওয়া তথ্যমতে, এক সময় দিনাজপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে কড়াদের একাধিক গ্রাম ছিল। নানা কারণে এরা পাড়ি জমায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। ভারতের ঝাড়খন্ড স্টেটের দুমকা, গোড্ডা, পাকুর, শাহীবগঞ্জ, হাজারিবাগ প্রভৃতি অঞ্চলে এখনো কড়াদের একাধিক গ্রাম রয়েছে। মোট ২৫ পরিবারে এদেশে কড়াদের মোট সংখ্যা মাত্র ৯৩ জন। শিশুদের সংখ্যা ত্রিশের মতো।
দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলাধীন হালযায় একটি গ্রাম। বৃটিশ শাসনামলে এই গ্রামের এক তৃতীয়াংশ জুড়ে ছিল কড়া সম্প্রদায়ের বাস। সে সময়ে তাদের হাল গৃহস্থি সবই ছিল, তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করত। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে শুরু হয় তাদের উপর অত্যাচার নির্যাতন। স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা নানা কৌশলে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে থাকে। এ ব্যপারে আইনের শরনাপন্ন হলেও নানা কুটকৌশলের কারনে তারা পরাভুত হয়। এহেন অবস্থায় বৃটিশ আমলে যে পরিবারের ২০বিঘা বা ১০ একর জমি ছিল তা ৫বিঘায় নেমে আসে পাকিস্থান আমলে। অতঃপর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সৃষ্ঠি হলে ধরে নেওয়া হয়েছিল, যে মুলমন্ত্রের উপর ভিত্তি করে দেশ স্বাধীন হয়েছে তাতে সকল ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় ও গোত্রের মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বসবাস করবে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তা হয়নি। বরং বেড়েছে আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন। সুযোগ সন্ধানী ভুমি দস্যুরা হয়েছে বেপরোয়া এবং গ্রাস করেছে সংখ্যালঘু আদিবাসী কোড়া সম্প্রদায়ের সকল ভুমি। এক সময়ে যাদের ছিল গোলা ভরা ধান গোয়াল ভরা গরু তারা এখন ভুমিহীন ও নিঃস্ব। অন্ন, বস্ত্র, ক্ষুধা এবং দারিদ্রতা তাদের তাড়িয়ে বেড়ায় তিন বেলা খাওয়ার বদলে একবেলা খেয়ে কঙ্কাল সার চেহারা নিয়ে বিষন্ন মুখে ফ্যাল ফ্যাল করে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকে। এই তাড়না থেকেই পাকিস্তান ও পরবর্তীতে বাংলাদেশ থেকে কড়া সম্প্রদায়ের অধিকাংশ পরিবার পালিয়ে যায় পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে। যারা আছেন তারা অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাতেন। কাজ করতে চাইলেও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদেরকে কাজে নেয় না। অথচ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী এমন মুক্তিযোদ্ধাও তাদের মধ্যে আছে এবং ক্ষুধা ও দারিদ্রের সংগে লড়াই করে বেঁচে আছে। তাদের বাস্তুভিটা ছাড়া কোন ভুমিই ছিল না। থাকলেও তা স্থানীয় ভুমিদস্যুদের দখলে রয়েছে।
সরকার যে সাতাশটি জাতিকে আদিবাসী ( সরকারি ভাষায় ক্ষুদ্র নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠী) হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে, সেখানে স্থান পায়নি কড়া জাতির নামটি। শুধু তা-ই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অনেক শিক্ষকেরই জানা নেই কড়া জাতির নামটি। এখানের আদিবাসীরা নিঃশব্দে অবলুপ্ত হচ্ছে এ দেশ থেকে। ক্রমেই আমরা হারিয়ে ফেলছি কড়া নামক একটি জাতি, একটি সভ্যতা আর একটি সংস্কৃতিকে।
২. আদিবাসী ও আদিবাসী বিতর্ক
আদিবাসী জনগণকে প্রাথমিক দিকে প্রথম জাতি, পাহাড়ি জনগোষ্ঠী, আদিম মানুষ, উপজাতি প্রভৃতি নামে চিহ্নিত করা হত। আদিবাসী শব্দটির প্রকৃত সংজ্ঞা ও তাদের অধিকার নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিতর্ক প্রচুর। জাতিসংঘের বিভিন্ন পর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার পরেও আদিবাসীদের ব্যাপারে সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য কোন সংজ্ঞায় উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি। সাধারণত কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় অনুপ্রবেশকারী বা দখলদার জনগোষ্ঠীর আগমনের পূর্বে যারা বসবাস করত এবং এখনও করে; যাদের নিজস্ব আলাদা সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও মূল্যবোধ রয়েছে; যারা নিজেদের আলাদা সামষ্টিক সমাজ-সংস্কৃতির অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যারা সমাজে সংখ্যালঘু হিসেবে পরিগণিত, তারাই আদিবাসী। আদিবাসীদের উপজাতি হিসেবে সম্বোধন করা একেবারেই অনুচিত, কারণ তারা কোন জাতির অংশ নয় যে তাদের উপজাতি বলা যাবে। বরং তারা নিজেরাই এক একটি আলাদা জাতি।
পাঁচটি মহাদেশে ৪০টির বেশি দেশে বসবাসরত প্রায় ৫,০০০ আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ কোটি। নীতি-নির্ধারণী প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়ায় যুগে যুগে এদের অনেকে প্রান্তিকায়িত, শোষিত, বাধ্যতামূলকভাবে একীভ‚ত হয়েছে এবং যখন এসব অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকারের স্বপক্ষে তারা কথা বলেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা দমন নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। জাতিসংঘের আলোচনায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এ বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে নেওয়া হয়েছে এবং ১৯৯৩ সালকে “আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী জনগোষ্ঠী বর্ষ” ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৫ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত “আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী জনগোষ্ঠী দশক” ঘোষণা করা হয় যার উদ্দেশ্য ছিল আদিবাসীদের উদ্বেগের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া। এছাড়া ১৯৯৫ সালের ৯ আগস্টকে “বিশ্ব আদিবাসী দিবস” ঘোষণা করা হয়। জাতিসংঘ ১৯৮২ সালে সর্বপ্রথম আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেয়।
আদিবাসী জনগোষ্ঠী তারা নিজেদেরকে মনে করে; তারা প্রকৃতির সন্তান। তারা নিজেরা প্রকৃতির অংশ, প্রকৃতির সাথে থাকে। তারা প্রকৃতির, প্রকৃতিই তাদের। তারা প্রকৃতির ধারক বাহক এমন কী রক্ষক। তারা প্রকৃতি থেকে আসে, প্রকৃতিতেই মিলিয়ে যায়। তারা ভূমির সন্তান। ভূমি থেকেই আসে এবং ভূমিতেই মিলিয়ে যায়।
অষ্ট্রেলিয়ার একটি আদিবাসী কবিতার মতো-
‘ভূমিই আদিবাসীদের অস্তিত্বের কেন্দ্র বিন্দু
ভূমি আদিবাসীদের ঠিকানা।
ভূমি জীবনের প্রতীক।
এ ভূমি আমাদের,
আমরাও ভূমির।
ভূমিতে আমরা বিশ্রাম নেই।
আমরা ভূমি থেকে আসি,
আবার ভূমিতেই ফিরে যাই।
তাই ত তারা ‘ভ‚মি’ বলতে বোঝে; মাটি, জল, জমি, জঙ্গল, জলবায়ু, আবহাওয়া ও এর উপরস্থ প্রাণিকূলসহ সম্পদকে।
কিন্তু বাংলাদেশ? যে দেশ ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছিল, যে দেশ অসাম্প্রদায়িক ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার চেতনাকে ধারণ করে স্বাধীন হয়েছিল সেই দেশের সরকার কিভাবে যারা নিজেদের উপজাতি স্বীকার করে না, এমন জাতিগোষ্ঠীকে ‘উপজাতি’ শব্দটি চাপিয়ে দিতে চায়? ইদানিং তো আইন করে তাদেরকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি বলা হচ্ছে। একটি গণতান্ত্রিক সরকার এভাবে একটি জনগোষ্ঠীর উপর অন্যায়ভাবে কোন কিছুকে চাপিয়ে দিতে পারে না। বাংলাদেশের সরকার যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে তা হলে সরকারকে দেশের সকল জনগোষ্ঠীর জাতীয় অস্তিত্ব ও তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, রীতি পদ্ধতিকে সম্মান দেখানো। কোন জনগোষ্ঠী কি নাম ধারণ করবে সেটি তাদের ব্যাপার। এখানে সরকারের হস্তক্ষেপের কোন অবকাশ নেই। বাংলাদেশ সরকার যদি বাঙ্গালী জাতিকে ‘উপজাতি’ হিসেবে অভিহিত করতে চায় নিশ্চয়ই তা বাঙ্গালী জাতি মেনে নেবে না। মেনে নেওয়া উচিত নয়। কারণ বাঙ্গালীরা একটি জাতি, তারা উপজাতি নয়। তা ছাড়া বাঙ্গালী জাতি ‘উপজাতি’ হবে, না ‘আদিবাসী’ হবে, না জাতি হবে- তা বাঙ্গালী জাতির বিষয়। সেখানে অন্য জনগোষ্ঠীর বলার কি থাকতে পারে? তেমনি ভাবে পার্বত্য চট্রগ্রামের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা বা সমতল এলাকার গারো, সাঁওতাল, মনিপুরীরা উপজাতি না আদিবাসী নাম ধারণ করবে সেটি তাদেরই বিষয়। সে ব্যাপারে যাদি কেউ হস্তক্ষেপ করে কোন কিছু চাপিয়ে দিতে চায়, এই আচরণের মধ্য দিয়ে প্রকৃত পক্ষে অগণতান্ত্রিক মনোভাবই প্রকাশ পায়।
জাতিসংঘের বিভিন্ন ঘোষণা এবং অন্যান্য আলোচনার প্রেক্ষিতে কোন জাতিগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত করার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা হয়। তাহলো-
প্রথমতঃ যারা আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামোর সীমানা নির্ধারণের পূর্ব থেকেই কোন একটি বিশেষ ভৌগলিক সীমারেখায় বসবাস করে আসছে।
দ্বিতীয়তঃ যাদের নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জীবন ধারণের একটি স্বতন্ত্র রীতি ও পদ্ধতি রয়েছে।
তৃতীয়তঃ যারা সংখ্যায় অল্প এবং সমাজের মূল ধারার জনগোষ্ঠী থেকে পিছিয়ে পড়া
চতুর্থতঃ যারা অদ্যবধি প্রাকৃতিক নির্ভর জীবন যাপন করে।
বাংলাদেশের সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি আদিবাসীদের জাতিগত অস্তিত্বের সাথে সম্পৃক্ত একটি বিষয়। কিন্তু সংবিধানে সরাসরিভাবে আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। এমনকি উপজাতি আদিবাসী হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সংখ্যালঘু জাতিগত স¤প্রদায় গুলো জাতিগত ও ধর্মীয় উভয় অর্থে সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। যদিও ১৯৭২ সালের বাংলাদেশের প্রথম সংসদে তৎকালীন নির্বাচিত সাংসদ জাতীয় জনসংহতি সমিতির নেতা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়টি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু দুঃজনকভাবে রাজনৈতিক দুরদর্শীতার অভাবে তা সংবিধানে অর্ন্তভূক্ত করা হয়নি। যদিও সরাসরি ভাবে আদিবাসীদের অধিকার বিষয়ে সংবিধানে কিছু বলা হয়নি তথাপিও সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদ পরোক্ষভাবে আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষেণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অনুচ্ছেদ ১৪, ২৮ এবং ২৯।
বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসীদের অধিকার স্বীকৃতি না থাকলেও পাশ্ববর্তী দেশ ভারত তার সংবিধানে আদিবাসীদের অধিকার বিষয়টি সন্নিবেশিত করেছে। ভারতীয় সংবিধানের ২৪৪ নং অনুচ্ছেদে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা প্রশাসন সম্পর্কীয় বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়াও ২৭৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার জনকল্যানে সরকার বিশেষ বরাদ্দ দিবে। উপরন্তু এই দুটি অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যায় ভারতীয় সংবিধানের সিডিউল ৫ ও ৬ এ আরো বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
শুধু ভারতে নয় সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশও তাদের সংবিধানে আদিবাসীদের অধিকারকে নিশ্চিত করেছে। তবে আদিবাসী অধিকারের বিষয়টি সংবিধানে অর্ন্তভূক্ত করার ক্ষেত্রে দক্ষিন আমেরিকার দেশসমূহ অগ্রগণ্য ভূমিকা নিয়েছে। কানাডার সংবিধানেও আদিবাসীকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে কানাডার ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হ অপঃ ড়ভ ১৯৮২ এর ৩৫ নং অনুচ্ছেদে কানাডার বিদ্যমান আদিবাসী এবং চুক্তিগত অধিকারগুলোকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং আদিবাসীদের ভূমি দাবী ও বন্দোবস্তের বিষয়টিকে অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধানে ২১১ ও ২১২ নং অনুচ্ছেদে আদিবাসীদের অধিকার বিষয়ে বলা হয়েছে। ২১১ তে বলা হয়েছে প্রথাগত আইনের আলোকে গঠিত প্রতিষ্ঠান, অবস্থান এবং সনাতনী নেতৃত্ব সংবিধান স্বীকৃত হবে এবং সে দেশের আদালতে যদি বিরোধীয় এমন কোন বিষয় আসে যা প্রথাগত আইনের সাথে সম্পৃক্ত সে ক্ষেত্রে প্রথাগত আইন কার্যকর হবে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ গুলোর মধ্যে কলম্বিয়া আদিবাসী অধিকারকে সবচেয়ে ভাল ভাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। সংবিধানের ২৬৪ থেকে ২৬৭ অনুচ্ছেদে এ সম্পর্কীয় বিষয়াদি বর্ণনা করা হয়েছে। গুয়েতমালার সংবিধানেও আদিবাসীদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ৫৮ নং অনুচ্ছেদে পরিস্কারভাবে বলা হয়েছে যে সাংস্কৃতিক সত্তার ভিত্তি বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী যারা মূল্যবোধ, ভাষা এবং প্রথাগতভাবে ভিন্ন তাদের জাতিগত অধিকার সংবিধান সম্মত। দক্ষিন আমেরিকার বৃহত্তম দেশ ব্রাজিলের সংবিধানেও আদিবাসীদের অধিকারকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ব্রাজিল সংবিধানের ১৭৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে সীমান্ত এলাকা এবং আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার ভূগর্ভস্থ এবং জ্বালানী উৎস আহরণে আইন দ্বারার নির্ধারিত নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে তা করতে হবে। আর্জেন্টিনার সংবিধানেও আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। আর্জেন্টাইন সংবিধানের ৬৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে রাষ্ট্র আদিবাসীদের পূর্ব অস্তিত্বের স্বীকৃতি দেয় যার মাধ্যমে আর্জেন্টাইন জাতির উদ্ভব হয়েছে। রাষ্ট্র তাদের জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক আত্ম পরিচয়ের এবং তাদের দখলে থাকা এবং সামাজিক মালিকানাধীন জমি যা তারা প্রথাগতভাবে লাভ করেছে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন নিশ্চিত করবেন।
সংবিধানে আদিবাসীদের সরাসরি স্বীকৃতি না থাকায় বিষয়টি বাংলাদেশের বহুত্ববাদী চরিত্রকে খর্ব করেছে। সমগ্র জনগোষ্ঠীকে মূলধারা ধরা হলে আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্যর অঙ্গহানী করা হয়। সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাওয়া ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীরসমূহের মৌলিক অধিকার। একইভাবে সাংবিধানিক অস্বীকৃতি ও অবমাননা মানবাধিকার লংঘনের সামিল।
৩. বাংলাদেশের আদিবাসী
সমতল ভূমিতে বসবাসরত আদিবাসী ঃ
ভূ-প্রকৃতিগতভাবে বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের মাটি খুব শক্ত, রুক্ষ লালচে রঙের এবং স্তরীভূত। ভূমির সাধারণ লেভেলের চাইতে এখানকার মাটি কখনো ২০-৪০ ফুট পর্যন্ত উঁচু। ফলে সমতল ভূমির তুলনায় এ অঞ্চলের চাষবাস করা অনেক বেশী দুরূহ ও কষ্টসাধ্য। এই কঠিন মাটির বুক চিরে তাকে ফসলী করে তোলার অনেকখানি কৃতিত্ব আদিবাসীরা দাবী করতে পারেন। সরকার গেজেটে যদিও ২৭ টি আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির নামের তালিকা প্রকাশ করেছে, এর মধ্যে সমতলের অল্প কটা আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির নাম রয়েছে।
সমতলের আদিবাসীদের যে তালিকা ইতোমধ্যে মাঠ সমীক্ষা মাধ্যমে আমারা প্রস্তুত করেছি তার সঙ্গে সরকারি নামের তালিকার বেশ ফারাক রয়েছে। তালিকা নিন্মে দেওয়া হলোঃ
১. সাওতাল
২. উঁরাও
৩. বেদিয়া (মাহাতো)
৪. রাজুয়াড়
৫. রায়/ভূমিজ
৬. মলি¬ক
৭. মাহালী
৮. কোল
৯. গঞ্জু
১০. পাহান/মুন্ডা
১১. মালো
১২. রাজবংসী
১৩. মাহাতো (কুর্মী)
১৪. বসাক
১৫. কোচ
১৬. গড়াইত
১৭. রায়/রাই
১৮. মুসহর
১৯. রবিদাস
২০. রাখাইন
২১. খাসিয়া
২২. বাগদী
২৩. ভূইমালি
২৪. সিং
২৫. ঘট মাঝি
২৬. গারো
২৭. হাজং
২৮. মনিপুরী
২৯. ত্রিপুরা
৩০. বানাইস
৩১. ঋষী
৩২. খেরোয়াড়
৩৩. মুরিয়া
৩৪. রামদাশ (চামার)
৩৫. হাড়ী
৩৬. তুরি
৩৭. লহার
৩৮.পাত্র
৩৯. পাহাড়িয়া
৪০. কর্মকার
৪১. কড়া
৪২. বর্মন
৪৩. ডালু
তিন পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসীদের পরিচিতি তুলে ধরা হলো-
১. চাকমা
২. মারমা
৩. ত্রিপুরা
৪. ম্রো
৫. তঞ্চঙ্গা
৬. বম
৭. পাংখোয়া
৮. চাক
৯. খিয়াং
১০. খুমি
১১. লুসাই
১২. উসাই (উসুই)
১৩. মং
সূত্রঃ এএলআরডি এবং মাঠ সমীক্ষা-২০১৯
তবে বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির তালিকা নিয়ে বেশ বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা যায়। দুঃখজনক হলেও এ কথা মানতেই হবে স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও আমরা আমাদের আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির সঠিক তালিকা প্রস্তুত করতে পারিনি। আজও এ বিতর্কে আমারা সময় পার করছি। অথচ ইতিহাস বলে মহান মুক্তিযুদ্ধে এ সমস্ত আদিবাসী জনগোষ্ঠিও দেশ রক্ষায় সমান তালে ঝাপিয়ে পড়েছিল। অনেকে দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন।
কোন কোন সূত্র মতে বাংলাদেশে ৪৫টি আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির বসবাস। তাদের মতে এরা হলো- অহমিয়া, খিয়াং, খুমী, গুর্খা, চাক, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা (জাতিগোষ্ঠী), পাংখো, বম, মারমা, ম্রো ও লুসাই, কোচ, খাড়িয়া, গারো, ডালু, বানাই, হাজং, খাসিয়া, পাত্র, মণিপুরি ও রাখাইন, ওরাওঁ, কন্দ, কোল, গন্ড, তুরি, পাহান, পাহাড়িয়া, বাগদি, বেদিয়া, ভ‚মিজ, মাহাতো, মাহালি, মালো, মুন্ডা, মুরারী, মুষহর, রাই, রাউতিয়া, রাজোয়াড় ও সাঁওতাল।
দিনাজপুর জেলার আদিবাসী সম্প্রদায়ের নাম ও জনসংখ্যার চিত্রঃ
এবার আসা যাক দিনাজপুর জেলার আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির তালিকা প্রসঙ্গে। মাঠ সমীক্ষাকৃত তথ্য নিন্মে দেওয়া হলো-
১. সাঁওতাল ৬২২২০
২. ওরাওঁ ৬২৩১
৩. কড়া ৮৫
৪. রাজবংশী ১৭০৪৩৭
৫. তুরি ১৫৮০
৬. কর্মকার ৫০৫
৭. ডোম ১৮৪
৮. পাহাড়িয়া ১৩২৯
৯. পাহান ১২১২
১০. ভূঁইয়া ২৪০
১১. মালপাহাড়িয়া ২৯৪
১২. মালো ১৩৯৪
১৩. মাহাতো ১১৪
১৪. মাহালী ১৬৯৭
১৫. মুন্ডা ৩৪৯
১৬. মুশহর ১৫৫৮
১৭. হরিজন ২৮৬৬
মোট ২৫২৩০৫
মাঠ সমীক্ষা-২০১৫/১৬ বিএসডিএ
৪. কড়াদের পরিচয়ঃ
কড়া শব্দটি একটি বিশেষ প্রাকৃত শব্দ। কড়া শব্দের অর্থ মাটি খোঁড়া বা খনন করা। এক সময় এ আদিবাসীরা দিঘি বা পুকুর এবং গভীর কুয়ো বা ইন্দিরা খোঁড়ার কাজে যুক্ত ছিলেন বলে এ খোঁড়ার কাজে যুক্ততা থেকে কড়া শব্দটি উদ্ভুত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ইংরেজ আমলে এ অঞ্চলে রেললাইন বসানোর কাজের সূত্র ধরেই ঝাড়খন্ড/দুমকা থেকে এদের আগমন বলে কেউ কেউ মনে করলেও ঠিক কবে কড়ারা বাংলাদেশে এসেছেন তার সঠিক কোন ইতিহাস অজানাই থেকে গেছে। যেহেতু প্রাচীন কালেও দিনাজপুর সহ বরেন্দ্র অঞ্চলে বড় বড় দিঘি বা পুকুর খোঁড়া বা খনন করা হয়েছিল সেহেতু প্রাচীন কালেও এদেশে এ কড়া আদিবাসীদের আগমন ঘটলেও ঘটতে পারে বলে মনে করা হয়। কড়া গ্রামটিতে সাঁওতালদের আধিক্য থাকলেও আছে ওরাঁও, ভুনজার, মুন্ডা পাহানসহ অন্যান্য আদিবাসী স¤প্রদায়।
বাংলাদেশে-দিনাজপুরে কড়াদের আগমনঃ
মাটি খোঁড়া থেকে কড়া শব্দটি এসেছে। এ সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের পূর্বপুরুষদের আমল থেকে দীঘি খোঁড়ার মতো কাজের সঙ্গে স¤পৃক্ত ছিল। সাতান কড়া জানান, কড়ারা এসেছে ভারতের দুমকা থেকে। রেললাইনের রাস্তা তৈরিতে মাটির কাজ করতেই এদেশে এ স¤প্রদায়ের আগমন বলে তিনি জানান। এদেশ থেকে কড়ারা নিঃশব্দে হারিয়ে যেতে থাকলেও ভারতের ঝাড়খন্ডে এখনও কড়াদের একাধিক গ্রাম রয়েছে। ইংরেজ আমলে সারা ভারত জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় বসেছে রেললাইন। পাহাড় কেটে, মাটি খুঁড়ে সেই রেললাইন বসানোর কাজে ঘাম ঝরিয়েছে এই আদিবাসীরাই। মূলত রেল লাইনের কাজের সূত্র ধরেই ভারতের ঝাড়খন্ড থেকে এদের আগমন ঘটে এ অঞ্চলে বলে ধরে নেওয়া হয়।
কড়াদের ধর্মঃ
কড়াদের ধর্ম সনাতন। তবে সনাতন ধর্মী হলেও এদের পূজোতে মূর্তির ব্যবহার নেই। অভাব মুক্তির জন্য এরা কারমা দেবতাকে তাদের নানা কষ্টের কথা শোনাতে কারমা পূজা, বিষহরি এবং গবাদিপশুর মঙ্গলের জন্য এরা গট পূজা পালন করে থাকে। তবে কড়া’রা তাদের ধর্মের কথা জিজ্ঞেস করলে বলে তাদের ধর্ম কারমা।
কড়াদের ভাষাঃ
কড়া’রা যে ভাষায় কথা বলে তাকে বলা হয়‘খট্টা’ ভাষা। মূলত বিশেষ অপভ্রাংশিক ভাষা এটি। এদেশে বসবাসরত কড়া’রা কথা বলে অলিখিত খট্টা বা পার্সী অপভ্রাংশিক ভাষায়। এ ভাষার লিখিত কোনো বর্ণ নেই। নেই কোনো লিখিত পুঁথি। তবে কড়া ভাষাকে মুন্ডারি ভাষা পরিবার গ্রুপের শ্রেণিতে পড়ে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দেন। অষ্ট্রিক প্রাক-দ্রাবিড় এই কোরা বা কড়া ভাষা অন্যান্য আন্দামানের ভাষার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত বলে দাবি করা হয়।
কড়া ভাষায় এরা-মা’কে ‘মেয়া’, বাবাকে ‘বাপা’, বোনকে ‘বোহেইন’, তিরকে ‘বিজার’, ধনুককে ‘ধেনি’, সূর্যকে ‘বেড়া’, রাতকে ‘রাইত’, সকালকে ‘বিহান’, মাছকে ‘মাছরি’ ও নদীকে ‘নেদি’ বলে।
তোমার নাম কী ? কড়া ভাষায় বলে, ‘তোর নাম কয়েন লাগলো’।
আপনি কেমন আছেন? কড়া ভাষায়- তোহনি কুরাং কে হে’।
বাংলা ভাষায় যেমন বচন এবং ইংরেজিতে নাম্বার এর ব্যাবহার আছে তেমনি আদিবাসী কড়া বা কোরা ভাষাতে এই বচন বা ঘটগইঊজ এর ব্যবহার আছে । যেমন- আমি / আমরা ইঞ / আলে
তুমি, তুই / তোমরা, তোরা আম / আপে
আপনি, আপনারা আপে
সে / ওরা, তারা – হানি / ইংকু, হাংকু
পদার্থ বাচকের ক্ষেত্রে ( কু )
কোনো পদার্থ বা দলগত কোনো গোষ্ঠির বহুবচনে ওই শব্দের শেষে কু শব্দটি ব্যাবহার করা হয় ।
যেমন-
ইঁটু ইটা; ইঁটগুলি – ইটাকু।
মানুষ হড় ; মানুষগুলি হড় কু।
বিশেষ্য পদেও ক্ষেত্রে-তুকু এর ব্যবহার:
বিশেষ্য পদ (নাম) এর বহুবচনের ক্ষেত্রে নামের শেষে ‘তুকু’ শব্দটি বসিয়ে বহুবচন করা হয়। যেমন-
শুরেশ রা শুরেশ তুকু।
পাপিয়া রা পাপিয়া তুকু।
আবার নামবাচক বা কোনো গোষ্ঠীর দুজনের বোঝাতে তিকিন শব্দটি ব্যবহার হয়। যেমন-
শুরেশরা শুরেশ তিকিন। ( দুজনকে বোঝাতে )
পাপিয়ারা পাপিয়া তিকিন।
অন্য আদিবাসী শিশুদের মতো কড়া আদিবাসী শিশুরাও তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত। ফলে বর্তমানে কড়া শিশুরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে বাংলা ভাষায়। এনজিও নির্ভর শিশু শিক্ষাকেন্দ্রই এদের একমাত্র ভরসা। এতদিন কড়া গ্রামে কোনো শিশুই এসএসসি উত্তীর্ণ হয়নি। সম্প্রতি লাপোল কড়াসহ দুই কিশোর এসএসসি’র সিঁড়ি পেরিয়ে অনেকটা সংগ্রাম করে এইচএসসিতে পড়ছে।
কড়াদের পেশাঃ
দেশের অন্য আদিবাসীদের মতোই কড়াদের পেশাও কৃষি। ফসল কাটা ও লাগানোর সময়টাতে এদের কাজ থাকে। বছরের বাকি সময়টাতে এরা দিনমজুরের কাজ করে। তাও দিনমজুরি সবার ভাগ্যে মিলে না। ফসল লাগানোর পর পরই এরা কর্মহীন হয়ে পড়ে। তাই চৈত্র-বৈশাখে আদিবাসীদের অভাব থাকে পাড়ায় পাড়ায়। কড়ারা এ সময়ে আশপাশ থেকে শাক, লতাপাতা আর জংলি আলু খেয়ে জীবন চালিয়ে নেয়। কখনো কখনো হঠাৎ করেই এই অভাবের মাসে সরকারের মাটি কাটার কাজের সুযোগ আসে কড়াদের। গড়ে সারা বছর কাজের জন্য প্রত্যেক শ্রমিক চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে কাজ পায়। কড়া স¤প্রদায়ের আদিবাসীরা খুবই অভাবি।
কড়া’রা গরু ছাগল পোষে। তবে এদের নিজেদের তেমন গুরু ছাগল নেই, সবিই পাশের গ্রামের কোন না কোন মহাজনের। আধিতে তারা এসব গবাদি পশু লালন-পালন করে থাকে।
৫. কড়াদের সমাজিক- সাংস্কৃতিক অবস্থা বিশ্লেষণঃ
পরিবার ও উত্তরাধিকার
কড়াদের সমাজে পরিবার হলো একটি ক্ষুদ্র সংস্থা। কড়াদের সমাজ এবং সমাজকাঠামো পিতৃতান্ত্রিক। পিতার দিক হতে সন্তানের বংশ পরিচয় এবং সামাজিক উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয়। বিয়ের পর স্ত্রীর গোত্র পরিচয়ের প্রাধান্য থাকেনা। মেয়েরা পিতার সম্পত্তিতে ভাগ পায়না। এদের সমাজে দুই প্রকারের পরিবার দেখা যায়। তাহলো,
ক. সরল বা (প্রাথমিক) একক পরিবার: স্বামী, স্ত্রী এবং তাদের অবিবাহিত পুত্র-কন্যা নিয়ে এ পরিবার গঠিত।
খ. যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবার: স্বামী, স্ত্রী ও তাদের বিবাহিত পুত্রদের স্ত্রী, তাদের সন্তান এবং অবিবাহিত পুত্র কন্যা নিয়ে গঠিত।
গ্রাম পঞ্চায়েতঃ
কালের স্রোতে কড়া সমাজে রূপান্তর ঘটলেও তাঁরা স্ব-সমাজের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলেছেন। এক সময়ের নিভৃত কিংবা বনচারী এ সম্প্রদায় একদা নোঙ্গর ফেলেছে লোকালয়ে। শিকড় ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। দিনাজপুর জেলার কড়াদের সমাজ জেলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ও হিন্দু সমাজের পাশাপাশি বসবাস করা সেত্ত্বেও কালের স্রোতে নিজেদের বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌছিলেও এখনও তাঁরা তাদের স্ব-সমাজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন। কড়াদের নিজস্ব সমাজ কাঠামো ও বিদ্যমান সামাজিক সংগঠন তাদের সুশৃঙ্খলা ও স্থিতিশীল কড়া সমাজ ব্যবস্থার পরিচায়ক। কড়া’রা জাতিগতভাবে স্ব-শাসিত সমাজ ব্যবস্থার পক্ষপাতি। ঐতিহ্যবাহী সামাজিক নেতৃত্ব এখনও কড়া সমাজে বিদ্যমান। এসব কারণে কড়াদের সামাজিক সংগঠন অত্যন্ত কার্যকরী ও শক্তিশালী। কড়া’রা নিজস্ব সমাজ কাঠামোর মধ্যে দিয়ে তাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত কার্য সম্পাদন করে থাকে। রাষ্ট্রীয় আইনকানুনের চেয়ে স্ব-সমাজের বিধি-বিধানের প্রতি তারা অধিকতর মনোযোগী। মূলত এটাই হচ্ছে আদিবাসী জনজীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
ক্ষমতা কাঠামোর অর্গানোগ্রামটি নিন্মরূপ:
কড়া আদিবাসীদের গ্রামগুলো পরিচালিত হয় ৩ সদস্যের গ্রাম পরিষদের মাধ্যমে। গ্রাম প্রধানকে এরা বলে মাহাতো। এছাড়াও রয়েছে গোড়াৎ ও পারামানি নামের দুটি পদ। পূর্বে কড়াদের কয়েকটি গ্রামের একজন প্রধান থাকত, তাকে বলা হতো পাঁড়ে। বর্তমানে কড়া’রা নিশ্চিনের পথে বিধায় এ পদটি আর নেই। এরা গ্রাম পরিষদের পদগুলো নির্বাচন করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সকলের মতামতের ভিত্তিতে। এ নিয়ে কড়াদের মধ্যে কোন মতপার্থক্য তৈরি হয় না। অন্যান্য আদিবাসী সস্প্রদায়ের মতো কড়ারাও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বেটকি ডেকে (সভা করে) ভোটাভুটির মাধ্যমে গঠন করে ৩ সদস্যের পরিষদ।
গ্রাম পঞ্চায়েতের অর্গানোগ্রাম
পাঁড়ে মাহাতো গোড়াৎ পারামানি
মাহাতোঃ
গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান বা কড়া গ্রামপ্রধানকে বলা হয় মাহাতো। গ্রামের সবকিছু তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। গ্রামের সকল সামাজিক উৎসবাদি, বিবাহ, মৃত্যু প্রভৃতি সম্পর্কিত বিষয়াদিসহ আইনগত বা বিরোধ নিস্পত্তিতে ইনি হলেন গ্রামের প্রধান কর্তা ব্যক্তি। তিনি গ্রামের ভাল-মন্দ সবকিছু দেখাশুনা ও তদারকি করেন এবং নেতৃত্ব দেন। মাহাতো হন গণতান্ত্রিক চরিত্রের। মাহাতো পদটি বংশানুক্রমিক। মাহাতোর সম্মানের জন্য পূর্বে তাকে নিষ্কর জমি ব্যবস্থা করে দেওয়া হত। মাহাতো যদি কোন কারণে গ্রামবাসীদের আস্থা হারায় তবে গ্রামের লোক মাহাতোকে বাতিল করে নতুন মাহাতো নির্বাচন করে, যার নাম ‘হুডিঙ মাহাতো’। কড়া সমাজে কেউ মাহাতো’র আদেশ অবহেলা বা অবজ্ঞা করে না। এমনকি শিকারকৃত পশুপাখির মাংস মাহাতোর সামনে এনে একত্র করা হয় এবং মাহাতো তা রীতি অনুযায়ী বন্টন করেন। গ্রামে কোন অন্যায় অপরাধ সংঘটিত হলে থানায় বা পুলিশে খবর দেওয়ার কাজটি মাহাতোর ওপর ন্যস্ত। আবার থানায় যদি কেউ যেতে চান, তবে তার আগে মাহাতোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হয়। গ্রামের আর চার-পাঁচজন তাকে সাহায্য ও সহযোগিতা করে থাকেন যাতে তিনি সুষ্ঠুভাবে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
সামাজিক আচার-সংস্কার-বিশ্বাসঃ
কড়াদের ধর্ম সনাতন হলেও এদের পূজাতে মূর্তির ব্যবহার নেই। অভাব মুক্তির জন্য এরা কারমা, দেবতাকে নানা কষ্টের কথা শোনাতে বিষহরি এবং গবাদিপশুর মঙ্গলের জন্য এরা গট পূজা পালন করে থাকে। অন্য সম্প্রদায়ে বিয়ে নিষিদ্ধ হলেও লোকস্বল্পতার কারণে কড়া আদিবাসীরা বর্তমানে অন্য সম্প্রদায়েও বিবাহ সম্পর্ক গড়ে তুলছে। এতে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের বিবাহ-কেন্দ্রিক স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও বিশ্বাসগুলো।
কৃষ্ণ কড়া জানায় এখন (কার্তিক মাস) অভাবের সময়, তাদের হাতে পয়সা নেই, তাই তামাশাও নেই। কড়া ভাষায় সে বলে : খোল রুপিয়া দেখ তামশা, রুপিয়া নেহি তো নেহি তামশা।
স্বভাব ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও চিকিৎসা পদ্ধতিঃ
কড়া’রা খুবই নিরহ এবং শান্ত স্বভাবের। তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্যও স্বাতন্ত্র্য। এ প্রসঙ্গে জগেন কড়া’র সঙ্গে আলাপ চারিতায় কড়াদের স্বভাব চরিত্র এবং তাদের সামাজিক কাঠামো সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। আলাপ চারিতায় ফুটে ওঠে কড়া সত্বার স্বরুপ।
জগেন কড়া। বয়স ষাটের ওপরে। কিন্ত বয়সের ভারে নুয়ে পড়েননি। সুঠাম তার দেহের গড়ন। গোত্রের সবাই তাকে বিশেষ মান্য করে। কারণ গোত্রের মাহাতো বা প্রধান তিনিই। একই সঙ্গে মাহান বা ওঝা হিসেবেও রয়েছে তার নাম ডাক। কেউ অসুস্থ হলে ডাক পড়ে তার। চিকিৎসায় তার অবলম্বন তন্ত্রমন্ত্র আর জঙ্গলের গাছগাছালির ওষুধ। কৃষ্ণা কড়ার প্রচন্ড মাথা ব্যথা। এর চিকিৎসার জন্যই সে মাহাতো বা গ্রাম প্রধারন এবং ওঝা জগেন কড়া’র কাছে এসেছে। কৃষ্ণা কড়া’র ঠিক সামনে এসে বসেন জগেন। তার এক হাতে একটি কৈচা/কাইদা (কাঁচি)। অন্য হাতে চেপে ধরেন কৃষ্ণা কড়া’র কপাল। চোখ তার বন্ধ। বিড়বিড় করে পড়ছেন মন্ত্র। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে কাঁচি দিয়ে বৃত্তাকার দাগ এঁকে নেন। এটিকে ভেবে নেয়া হয় কৃষ্ণা কড়া’র মাথা। এই মাথাকে ব্যথামুক্ত করতে হবে মন্ত্রের শক্তিতে। একবার মন্ত্র পড়া শেষ হতেই জগেন কড়া ফুঁকে দেন কৃষ্ণর মাথাটি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে বৃত্তাকার দাগটিকে হাতের কাঁচি দিয়ে কেটে দেন। এভাবে চলে তিন বার ফুঁক দেয়া। তিন ফুঁকে বৃত্তাকার দাগটিও তিন জায়গায় কেটে দেয়া হয়। এভাবেই চলে মাথা ব্যথার চিকিৎসা। দাগ কাটার মাধ্যমে তিনি মূলত কৃষ্ণর মাথা ব্যথা কেটে দেন। তিন ফুঁকে কৃষ্ণাও বেশ আরাম অনুভব করে। কীভাবে এটি হয়? উত্তরে কৃষ্ণা কড়া বলে, বাবু, বিশ্বাসে বস্তু মিলে। শিক্ষিত সমাজে যা কুসংস্কার, এ পাড়ার সকলের কাছে তা পূর্বপুরুষদের বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাসকে বুকে ধরেই বেঁচে আছে এখানকার কড়া’রা।
হারিয়ে যাওয়া বস্তু উদ্ধার, সাপের বিষ নামানো, পেটব্যথা বা মাথাব্যথা কমানো, রাতের বেলা পথ চলতে যেন সাপে না কাটে সে কারণে সাপের মুখ বন্ধ করা, সবই চলে মন্ত্র দিয়ে। জগেন কড়া বলেন সবই সৃষ্টিকর্তা করে, আমরা কিছু করি না। শুধু তার নাম নিয়ে মন্ত্র পড়ে যাই। তার মতে যে মাহান (কবিরাজ) মিথ্যা বলে না, পাপ কাজ থেকে বিরত থাকে- তার শক্তি তত বেশি। সে তত ভালো মাহান।
বিবাহ বা বাপলাঃ
কড়াদের বিয়ে বা বাপালা অনূষ্ঠানটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। কড়াদের বিয়ের প্রথমে ঘটক বা কারোয়ার সাথে কনেকে দেখতে আসে ছেলের বাবা। আপ্যায়নের পর মেয়ে পছন্দ হলেই পাকাপাকি হয় বিয়ের কথাবার্তা। বিয়ের সে আনন্দে চলে হাঁড়িয়া খাওয়া। এদের বিয়েতে এখনও মেয়েকে পণ হিসেবে দিতে হয় ২৫ টাকা। তাছাড়াও মেয়ে পক্ষকে ৭টি শাড়ি, ৩ সের (এখন কেজিতে) খাবার তেল, ৩ পুরিয়া সিঁন্দুর আর ডারিয়া ঝোপা (কোমরে সাজানোর এক ধরণের উপকরণ) দেয়ার বিধান চালু আছে। কড়া আদিবাসীদের বিয়েতে বাড়ির উঠানে পাতা দিয়ে মারোয়া সাজানো হয়। মাটি উঁচু করে চারদিকে ৪টি কলাগাছ, ৪টি তির, কাল সাট লিয়া (মাটির ঘটি বিশেষকে বলা হয়) রেখে সুতা দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়। বিয়ে বাড়ির উপরে বাঁশ দিয়ে উঁচু করে টানাতে হয় বাদর। খড় দিয়ে মানুষের প্রতিকৃতি তৈরী করে তাতে তীর ধনুক লাগিয়ে তৈরী করা মুর্তি বিশেষকে কড়া’রা বাদা বলে। এরা মনে করে বাদর টানিয়ে সারা গ্রামে তাদের বিয়ের জানান দেয়া হয়। বিয়ের আগে হয় গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানে গান গেয়ে গেয়ে বর-কনেকে হলুদ দেওয়াই হলো প্রথাগত নিয়ম। বিয়ের পূর্বে নাউয়া (নাপিত) এসে কনের হাতের কানি আঙ্গুল (কনিষ্ট আঙ্গুল) কেটে সামান্য রক্ত নিয়ে তার সঙ্গে আতপ চাল একত্র করে মহুয়া পাতা দিয়ে কন্যারই হাতে বেধে দেয়। কড়া ভাষায় এটি নিউওয়ে। বরকেও একইভাবে বাড়ি থেকে মহুয়া পাতা বেধে আসতে হয়।
কড়াদের বিয়েতে কনেকে গোসল করাতে লাগে ১০জন লোক। এদের মধ্যে ৫জন পুরুষ ও ৫জন মেয়ে হতে হয়। গোসলের পরই বিয়ের শাড়িতে সাজানো হয় কনেকে। কড়াদের বিয়েতে প্রথমে বরপক্ষ কনের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করে। সেখানেই তাদের আপ্যায়ন করা হয়। কড়ারা একে বলে জাতি মিলন। অতঃপর বরকে বাড়িতে এনে প্রদীপ, ধান ও ঘাস দিয়ে বরণ করা হয়। একই সাথে তাকে রূপার আংটি পরিয়ে খাওয়ানো হয় গুড়। কড়া ভাষায় এটিকে গুড় খিলা বলা হয়।
বিয়ের মূল পর্বকে এরা বলে সিমরেত হতে বা সিঁন্দুর পর্ব। এই পর্বটি বেশ নাটকীয়। কনের ভাইকে উঠতে হয় তার দুলাভাইয়ের (বরের কাঁধে) কাঁধে আর বরকে গামছা নিয়ে উঠতে হয় তার দুলাভাইয়ের (বোহনাই বা বড় বোনের স্বামী) কাঁধে। এ অবস্থায় বর তার কাছে থাকা গামছাটি কনের ভাই বা শ্যালক বা শালা কে দিয়ে দেয়। আর শ্যালক বা শালা ঐ অবস্থায় বরকে পান খাইয়ে দেয়। পান খাওয়ানোর পর শ্যালক বা শালা ঐ গামছাটি বরের কাঁধে পরিয়ে দেয়। গামছা পরানোর সাথে সাথেই বর কাঁধ থেকে নেমে চলে আসে সাজানো মারোয়ার দিকে।এই আদিবাসী বিয়েতে বর-কনের সিঁদুর পর্ব হয় চাষাবাদের প্রতীক জোয়ালের উপর দাঁড়িয়ে গোপনীয়ভাবে। দুই পক্ষের মাহাতোর বা গ্রাম প্রধানের উপস্থিতিতে জোয়ালের দু’দিকে বর ও কনে দাঁড়ানোর পর পরই চারদিকে কাপড় দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয় আর ঐ অবস্থায় বর কনেকে সিঁদুর পরায়। সিঁদুর পর্বের পরই বর-কনেকে খাওয়ানো হয় বিশেষ খির। সিঁদুর পর্বের পর বর-কনেকে পালন করতে হয় খান্দা বা দশের খাবার পর্ব। নতুন হাড়িতে বা যেটিতে খাবার রান্না হচ্ছে সেই হাড়িতে একটি কুলায় থাকা ঘাস, চাল ও ধান বর-কনেকে এক সাথে ঢেলে দিতে হয়। আদিবাসী কড়ারা বিশ্বাস করে খান্দা বা দশের খাবার পর্ব পালনের পর থেকেই বর-কনে ধর্মীয়ভাবে একে অপরের স্বামী-স্ত্রী হয়ে যায়। অতঃপর পরিচিত জনেরা ঘাস আর ধান ছিটিয়ে নব দ¤পতিকে আর্শিবাদ করে আর কনের হাতে গুজে দেয় নানা উপহার সামগ্রি।
সকলের খাওয়া শেষে শুরু হয় হাঁড়িয়া খাওয়া আর কড়া সম্প্রদায়ের ঝুমের নাচ। আনন্দের সঙ্গে কড়ারা বলে, মারোয়ামে ঝুমের নাচ বে, হেরিয়া সবিল মিলকে পি বে। আর অন্যদিকে চলতে থাকে দান বা বান্দা পানি পর্ব। গ্রামের প্রায় সবাই এবং বিশেষ পরিচিত আত্মীয়-স্বজনরা ঘাস আর ধান ছিটিয়ে বর-কনেকে আশীর্বাদ করে আর কনের হাতে গুঁজে দেয় নানা উপহার। এভাবেই শেষ হয় আদিবাসী কড়া সম্প্রদায়ের বিয়ে।
বিবাহ বিচ্ছেদঃ
কড়া আদিবাসীদের বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মত পার্থক্য তৈরী হলে বা বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে উভয়পক্ষের মাহাতো ও দশজনের উপস্থিতিতে পালন করতে বিশেষ ধরণের আচার। কড়া’রা এটিকে বলে পাতপানি আচার। একটি কাসার বাটিতে পানি নিয়ে ৪/৫টি আমপাতাসহ একটি ভাঙা ডাল ডুবিয়ে রাখতে হয়। অতঃপর কাসার বাটির দুইদিকে দাঁড়িয়ে স্বামী ও স্ত্রী দুটি পাতা ধরে এবং একই সাথে টেনে পাতা ছিড়ে ফেলে। প্রথা অনুসারে পাতা ছেড়ার সাথে সাথেই তাদের বিবাহের বিচ্ছেদ ঘটে।
শিশুর জন্ম, নামকরণ ও আচার অনুষ্ঠানঃ
কড়া’রা নবজাতক জন্মানোর ৭ অথবা ৯ দিনের দিন নাপিত ডেকে গোত্রের সবার চুল দাড়ি কেটে শুদ্ধি করায়। ওই দিনই নবজাতকের নাম রাখা হয় এবং সবার জন্য ভোজের ব্যবস্থা করা হয়। কড়া ভাষায় এটিকে বলা হয় ছেটি করানো। কড়া’রা বলে, নাম রাখল হোতে, ছেটি কারল হোতে। কড়াদের নিয়মে নবজাতকের নাম রাখেন গোত্র প্রধান বা মাহাতো। ছোট বেলাতেই কড়াদের হাত কেটে ঘা করে কাকড়া ও বিছার প্রতিকৃতি তৈরি করা হতো। কড়া’রা এটিকে বলে খোদনা করা বা জাতির চিহ্ন। অতীতে খোদনা বা জাতির এই চিহ্ন দিয়েই চেনা যেত কড়াদের। কিন্তু এখন এর প্রচলন নাই বললেই চলে। নতুন প্রজন্মের কড়া’রা তেমন এ বিষয়ে জানেন না বললেই চলে।
মৃত্যু ও আচার অনুষ্ঠানঃ
কড়া আদিবাসীদের মৃত্যু হলে তার লাশ গোসল করিয়ে লম্বালম্বিভাবে সাদা কাপড় পরানো হয়। অতঃপর মাটির পাতিলে জ্বালানো আগুন রেখে পাতিলগুলো দেয়া হয় ১০ জনের হাতে। কোনো মন্ত্র পাঠ ছাড়াই লাশটিকে ১০ জনে নিয়ে যেতে থাকে কবরস্থানের দিকে। সবার সামনে থাকে গোত্রের মাহাতো। তার গলায় বাধা গামছায় থাকে খই আর সরিষা। বাড়ি থেকে লাশ নেয়ার সময় থেকেই মাহাতো খই আর সরিষা ছিটাতে থাকে। কোনো বাঁশ ছাড়াই কড়ারা মৃত দেহ মাটিচাপা দেয়। কবরে মৃতের মাথা থাকে উত্তরে আর পা দক্ষিণে। এরা বিশ্বাস করে ৬ মাস পর্যন্ত মৃতের আত্মা চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। তাই মৃতের বাড়িতে তার স্বজনেরা বিধান অনুসারে ৩দিন রান্নায় হলুদ ও লবন ব্যবহার করে না। ৩দিন পরে বাড়িতে হয় তেলখের অনুষ্ঠান। এদিন গ্রামে নাপিত এসে সবার চুল ও দাড়ি কামিয়ে দেয়। আর মেয়েদের কানি আঙ্গুলের নখ বেøড দিয়ে হালকা ভাবে ঘষে দেওয়া হয়। কড়াদের বিশ্বাস এতে গোটা গ্রামের শুদ্ধি ঘটে।
খ্যাদ্যাভাসঃ
কড়া আদিবাসীদের প্রধান খাবার ভাত। পছন্দের খাবারের মধ্যে ঘংঘি (শামুক), মুসা (ইঁদুর), খোকরা (কাকড়া), কুচিয়া, দুরা (কচ্ছপ), ধারা (গেছো ইদুর), ঝিনুক, কুকুরী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। হাড়িয়া এদের প্রিয় পানীয় এদের উৎসব ও পূজাপার্বনে হাড়িয়ার ব্যবহার রয়েছে।
নেশা জাতীয় খাদ্য ও পানীয়ঃ
হাড়িয়া এদের প্রিয় পানীয়। ভাতকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় চাপিয়ে হাড়িয়া প্রস্তুত করা হয়। বিয়েসহ যেকোন উৎসবে এ হাড়িয়া না হলে এদের চলে না। নারী পুরুষ নির্বিশেষ সবাই এ হাড়িয়া খেয়ে থাকে। বলা হয় এই হাড়িয়া খাওয়ার জন্য কড়াদের জীবনী শক্তি অনেক কমে যায়। ফলে পুরুষরা শারীরিকভাবে অনেক দূর্বল বলে প্রতিয়মান। এছাড়াও অনেকে তামাক গোলা খায়।
পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলংকার ও প্রসাধন সামগ্রীঃ
এ আদিবাসী নারীদের এক সময় নিজস্ব পোশাক ছিল। কড়া ভাষায় এটি পেনছি। বর্তমানে শাড়ি সস্তা হওয়ায় অধিকাংশ নারীরাই পেনছি ব্যবহার করে না। এছাড়া অলংকার হিসেবে তারা গলার মালা, কানসি, ঝুমকা, ফুটকি (নাকের ফুল), ঘড়কে পেনজাল (পায়ের নুপূর) প্রভৃতি ব্যবহার করে। কড়া আদিবাসীদের প্রধান পেশা কৃষি। কৃষি কেন্দ্রিক জীবনে পুরুষরা লুঙ্গি গামছা এবং পাঞ্জাবি ধূতি ব্যবহার করে। বর্তমানে এরা বাঙ্গালিদের মতই সাধারণ পোষাক পরিচ্ছদ পরিধান করে।
লোকবিশ্বাসঃ
কড়াদের পূর্বপুরুষদের কিছু লোকবিশ্বাসের কথা জানা যায়। তারা বিশ্বাস করে যদি, বাতাস পূর্বে-পশ্চিমে প্রবাহিত হলে নাকি বড় ধরণের ঝড় হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার কোনো কাজে যাওয়ার সময় খালি কলসি দেখলে যাত্রা হয় অশুভ। তারা বিশ্বাস করে গভীর রাতে কুকুর কাঁদা নাকি অমঙ্গলের লক্ষণ। মোরগ-মুরগি জোড়া ঝগড়া করলে বাড়িতে মেহমান আসে বলে তাদের বিশ্বাস। আবার রাতের বেলা পশ্চিমে বা দক্ষিণে সাপ দেখলে দিক ভেদে প্রচন্ড বর্ষা বা খরা ভাব দেখা দিতে পারে। চলার পথে যদি বামদিক থেকে কোন প্রাণী ( শৃগাল, বেজি) রাস্তা পার হয়ে ডান দিকে যায় তাহলে যাত্রা নাকি অশুভ হয় বলে তারা মনে করে। এই বিশ্বাসগুলো এখনো মিশে আছে আদিবাসী কড়াদের জীবনের সঙ্গে। তারা কথায় কথায় এই বিশ্বাসগুলো মনে প্রাণে ধারণ ও লালন করে। কড়াদের ঘরগুলো বেশ ব্যতিক্রম আর সবার মত নয় একদম অন্যরকম। মাটিতে ঘেরা এ সমস্ত ঘরে কোনো জানালা থাকে না। মাটির এসব ঘরদোর এবং বাড়ির উঠোনসহ পুরো বাড়ি কড়া’রা বেশ কড়া করে মাটির সঙ্গে গরুর গোবর গুলিয়ে লেপ দেয়। এত করে তাদের বাড়িতে পোকামাকড়ের উপদ্রপ কম হয় বলে তাদের বিশ্বাস। আবার ঘরের ভিতর যেন বাইরে থেকে কোনো অপদেবতা বা অনিষ্টকারী কেউ যেন ঘরের ভেতর নজর দিতে না পারে তাই তারা ঘরে জানালা রাখে না-এ রকম হাজারো বিশ্বাসের ধারন ও লালন-পালন করে কড়া’রা।
গৃহায়ন, বসতি ও গৃহস্থালীর তৈজসপত্রঃ
কড়াদের বাড়িগুলো হয় মাটি আর খড়ের ছনে ছাওয়া। তবে এদের ঘরগুলোতে কোনো জানালা থাকে না। অপদেবতার কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতেই এ ব্যবস্থা। মাটির এ সমস্ত জানালাবিহীন ঘরে এ বছরের পর বছর বসবাস করছে একান্ত আপন পরিবেশে। তাদের ব্যবহার্য তৈসজপত্রের মধ্যে একসময় মাটির তৈরি বাসনপত্র ব্যবহার করলেও বর্তমানে এরা গিলটির ( টিনের সংকর) থালা-বাসন ব্যহার করছে, কেউবা কাঁসা কিংবা ম্যালামাইনের তৈজসপত্র আবার কেউ কেউ স্টিলের বাসনপত্র ব্যবহার করছে। শামুক ঝিনুকের খোলকও এরা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে। এরা বাঁশের তৈরি আসবাব পত্রও গৃহস্থলির বিভিন্ন কাজে ব্যহার করে।
কড়াদের প্রযুক্তিঃ
কড়া’রা একেবারে আদিম প্রযুক্তি ব্যবহার করে। তীর ধনুকে একসময় তারা বনে জঙ্গলে শিকার করতো। বিশেষ কায়দায় বাঁশের বেড়িতে তারা গবাদি পশুকে বেঁধে রাখে। গরুর মুখে জঙ্গলি গাছের শাখা দিয়ে গোমাই (মুখে পরানো মুখোশ যেন গরু অন্যের ফসল খেতে না পারে)। মাটি খোড়ার জন্য তাদের রয়েছে বিশেষ খন্তি (লোহার ফলা বা লম্বা লোহা দিয়ে তৈরি মাটি কাটার যন্ত্র) এবং কুয়োর মধ্যে কোন জিনিস পড়ে গেলে তা তুলে আনার জন্য বিশেষ কাকড়াই (খঞ্জনি)। খড়ের বিশেষ বেড়িতে তারা তাদেও ফসল রাখতো। আগাছা পরিস্কারের জন্য তাদের রয়েছে বিশেষ আগাছা তোলার যন্ত্র বিদা ( কাঠের উপর ফলা লাগিয়ে চিরণীর মতন যন্ত্র বিশেষ)। কড়া’রা মাটির হাড়ি পাতিলে রান্না করতো তবে বর্তমানে তারাও আমাদের মত এলুমিনিয়াম ও মেলামাইনের তৈজসপত্র ব্যবহার করে। তারা বিশ্বাস করে মাটির পাতিল ব্যবহার না করাই গ্যাস্টিক সমস্যার মূল কারন।
ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্মাচার পূজা পরব বা উৎসবঃ
বাংলাদেশের অন্যসব আদিবাসীদের মতো কড়ারা কোনো বৈশাখ পালন করে না। পাড়ার এককোণে বাঁশের তৈরি কাগজে মোড়ানো ছোট্ট ঘর আকৃতির পাশেই মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে উঁচু ঢিবি। মাহাতো বলেন এটি তাদের শিব পূজার স্থান এবং এটিই তাদের বলা যায় একমাত্র মন্দির। কড়া’রা মাঘের অমাবস্যায় ঐ স্থানেই শিবের পূজা করে। কড়াদের কাছে এটি শিবরাত্রি। গত শিবরাত্রির নানা আনুষ্ঠানিকতার কথা লেখককে বলেন জগেন কড়া। নিয়মানুসারে পূজার আগের দিন এরা ভগবানের কৃপা লাভের আশায় উপোস থাকে। ঐদিন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামতেই শুরু হয় পূজোর আনুষ্ঠানিকতা। কড়া পাড়ায় রাতভর চলে দেহতাত্ত্বিক (দেহতরি) গান-বাজনা। শিবরাত্রির পূজার যথার্থ সময় হলো মধ্যরাত। এ সময় (মধ্যরাতে) সময় কড়া’রা একটি বাঁশের চালনে প্রদীপ জ্বালিয়ে, কলা, সুপারি, ঘাস, ফুল, ধান, সিঁদুর দিয়ে ভক্তি দেয়। অতঃপর উলুধ্বনি দিয়ে এরা উচু করা মাটির ঢিবিতে (তাদের মতে শিবের মাথায়) দুধ ঢালে। কোনো মন্ত্র ছাড়াই প্রথমে মাহাতোসহ দশজন সমাজের পক্ষে দুধ ঢালে। এরপর একে একে যারা উপোস থাকে তাদের দুধ ঢালতে হয় আলাদা ভাবে। কড়া’রা কোনো মূর্তিপূজা করে না, তাদের কাছে শিবের কোন মূর্তি নেই। তৈরি করা মাটির ঐ উঁচু ঢিবিটিই কড়াদের কাছে শিব দেবতা। পূজো শেষে ভোর রাতে এরা সবাই গোসল সেরে আরেকবার শিবের মাথায় দুধ ঢালে একই নিয়মে। দুধ ঢালার সময় কড়া’রা প্রার্থনা করে যেন তাদের মনোবাসনা পূরণ হয়। অভাব যেন দূর হয়।
বর্ষচক্র ব্যাপী বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় উৎসব বা পরব কড়া সমাজের একটি স্বাভাবিক বিষয়। কড়া’রা ফাল্গুন মাস থেকে তাদের বছর গণনা শুরু করে এবং মাঘ মাস পর্যন্ত বিভিন্ন পূজা পরব উদযাপন করে। উৎসব-আনন্দ অনুষ্ঠান ছাড়া কড়া সমাজ চিন্তা করা যায় না। এ ব্যাপারে হিন্দুদের বারো মাসে তেরো পূজা প্রবাদের সঙ্গে সঙ্গতি লক্ষ্য করা যায়। কড়া উৎসব পরবের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এদের কোনো অনুষ্ঠানে হিন্দুদের মত আলাদা কোনো ঠাকুরের প্রয়োজন হয় না। পরব পালন ও ধর্মাচরণের একান্ত নিজস্ব রীতি ও পদ্ধতি আছে। যে কোনো উৎসব অনুষ্ঠান পালনের কোনো নির্দিষ্ট তারিখ নেই। সমাজের লোকেরা একত্রে বসে পরামর্শক্রমে সুবিধা অনুযায়ী অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণ করেন। এই উৎসব পালনের মধ্যেও রয়েছে তাদের ধর্মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ ও ঐকান্তিকতা। প্রায় প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানে রয়েছে নৃত্য-গীত, পান-ভোজন ও আনন্দ-উল্লাস। কড়াদের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান উৎসবের নাম অঞ্চলভেদে ভিন্ন হতে পারে, তবে উৎসবের মূল বৈশিষ্ট্যে কোন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়না।
কড়াদের মধ্যে বেশ কয়েকটি পরব-উৎসব রয়েছে। কড়াদের উল্লেখযোগ্য পূজা পার্বনের মধ্যে ফাল্গুন মাসে সালসেই, চৈত্র-বৈশাখ মাসে হোম, আষাঢ় মাসে হাড়িয়াও, আর্শ্বিন মাসে দাঁশাই, এ্যারকসীম সহ জান্থর, রুড, কারাম, গট এবং লবাণ ইত্যাদি । যে কোনো উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু হলো আত্মোৎসর্গ করা। কড়াদের জীব বলি কৃষি বিষয়ক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত এবং তা দেবোদ্দেশ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত।
কারমা পূজাঃ
কড়া আদিবাসীদের বড় উৎসব কারমা পূজা। এরা ভাদ্র মাসে এ পূজা পালন করে ধুমধামের সাথে। মূলত এটি গাছের পূজা। বিশেষ প্রজাতির খিল কদম গাছের ডাল কেটে এনে পূজা করে এ আদিবাসীরা। কারমা পূজায় বিবাহিতরা খিল কদম গাছের ডাল কাটতে পারে না। গোত্রের মাহাতো পূর্ব থেকেই অবিবাহিত কোন যুবককে কয়েক বছরের জন্য ডাল কাটা ও বির্সজনের জন্য মনোনিত করে দেন। ডাল কাটার দিন নদীতে স্নান করে গাছের গোড়ায় ধুপ জ্বালিয়ে, সিঁদুর দিয়ে ৩টি তেলের পিঠা গাছের সাথে বেঁধে দেয়া হয়। অতঃপর ৩ চটে (৩ কোপে) ডাল কাটা হয়। ডালটি মাটিতে পড়ার পূর্বেই সেটি ঘাড়ে করে নিয়ে যাওয়া হয় পূজাস্থলে। সেখানে গোত্রের সবাই ঢাক-ঢোল বাজিয়ে ডালটিকে মাটিতে গেড়ে বা গেঁথে দেয়। একই সাথে দুটি লাল মুরগা (মোরগ) বলি দেয়ার মাধ্যমে শুরু হয় কারমা পূজার আনুষ্ঠানিকতা। সারা রাত চলে নাচ, গান আর হাড়িয়া খাওয়া। ভোর বেলা দলের মাহাতো স্নান সেরে ভেজা শরীরেই প্রথমে এক বাটি দুধ ঢেলে দেয় খিল কদম গাছের ডালের মাথায়। অতঃপর তাকে ভক্তি করে ফিরে যায় নিজ বাড়িতে। মাহাতোর পরপরেই অন্যান্যরা একে একে দুধ ঢালতে থাকে। দুধ ঢালা শেষে যে যুবকটি ডাল কেটেছিল সে প্রথমে ডালটির চারদিকে ৩ পাক ঘুরে ডালটিকে টান দিয়ে কাঁধে তুলে নেয়। অতঃপর ঢাক-ঢোলের তালে তালে সেটিকে বির্সজন দেয় নিকটবর্তী নদী বা পুকুরে। কারমা পূজায় কড়াদের ধর্মের পরীক্ষা দিতে হয়। বাঁশের ডালার মধ্যে কালাই বীজ রেখে বালু ও মাটি দিয়ে যেদিন ঢেকে দিতে হয়। সেদিন থেকেই শুরু হয় উপোস (উপাস)। উপোস সময়ে রসুন, পেঁয়াজ, গরমভাত, মাছ ও মাংস খাওয়ার নিয়ম নেই। খেতে হয় শুধুই নিরামিষ। যে কয়জন উপোস থাকে সে কয়টি ছোট কাঠি ডালায় (বাঁশের তৈরি একধরনের তৈজসপত্র) পুতে দেওয়া হয়। কড়াদের রীতি অনুসারে উপোসকারী পুরুষ হলে কাঠির মাথায় কাঁজল আর মহিলা হলে সিঁদুর লাগানো হয়। চারদিন পর ডালায় নতুন চারা গজালে এরা উপোস ভাঙে। কড়াদের বিশ্বাস যাদের ধর্মে বিশ্বাস নেই ডালায় তাদের লাগানো কালাই বীজ থেকে চারা গজায় না। চারা গজালে বন থেকে কেটে আনা খিল কদম গাছের ডাল মাটিতে পুতে চারার ডালাটিও তার পাশে রাখা হয়। কড়া আদিবাসীরা আজো বিশ্বাস করে কারমা তাদের অভাব মুক্তি আর সৌভাগ্য লাভের পূজা। কারমা ছাড়াও এ আদিবাসীরা পালন করে বিষহরি পূজা। তবে তা একেবারেই অন্যরকম। কড়ারা বিশ্বাস করে এ পূজায় তাদের অভাব ও কষ্টের কথা শুনতে তাদের ওপরই ভর করে নেমে আসে ৬টি ভ‚ত (দেবতা)। ভ‚তগুলোর নাম- গাঁও রাখ ওয়াল, দানব, বিষহরি, চকর গুরু, কামরুক গুরু ও বাংশিং গুরু। এ পূজায় মাটি দিয়ে উঠানে ৪ আঙুল উঁচু ডিবি তৈরি করে সেখানে ধূপ জ্বালিয়ে, সিঁদুর দিয়ে কবুতর বলি দেয়া হয়।
ভ‚ত বা দেবতাকে শান্ত করার জন্য রাখা হয় বিশেষ ধরণের গাছের চাবুক। ভক্তি করে মাদল বাজিয়ে এরা নাচতে নাচতে দেবতাদের ডাকতে থাকে। কড়া’রা বিশ্বাস করে এতে তাদের গোত্রের তুলা রাশির ব্যক্তিদের ওপর দেবতা ভর করে। কখনো কখনো দেবতা আসতে দেরি হলে পুতার (মসলা বাটার) পাথরে ধূপের ধোঁয়া দিয়ে তার ওপর তুলারাশির লোক দাঁড় করালেই দ্রæত দেবতারা চলে আসে। দেবতাদের প্রথমে চাবুক দিয়ে শান্ত করে বলা হয় মাহারাজ তয় শান্ত হওয়া। দেবতারা শান্ত হলে গোত্রের সকলেই নানা রোগ-শোক ও সমস্যার কথা তাকে জানায় এবং সমাধানের মিনতি করে।
গট পূজোঃ
কারমা ও বিষহরি ছাড়াও গবাদিপশুর মঙ্গলের জন্য কড়া’রা পালন করে বিশেষ ধরণের এক পূজা। কড়া ভাষায় এটিকেই বলা হয় গট পূজা। এ পূজায় কাদামাটির ওপর ডিম রেখে, সেখানে সিঁদুর দিয়ে, ধান আর দুর্বা ঘাসে ঢেকে দেয়া হয়। অতঃপর তার ওপর দিয়ে গোত্রের সকলের গরু একসাথে নিয়ে যাওয়া হয়। যার গরুর পায়ে লেগে ডিমটি ভেঙে যায় তাকে সকলে ঘাড়ে চড়িয়ে হৈহুল্লোর করে তার বাড়িতে নিয়ে আসে। সবাইকে তখন সেই সৌভাগ্য কড়াকে অন্যান্য খাবারের সাথে খাওয়ানো হয় হাঁড়িয়া। নিয়ম মতে ওই দিনই সূর্য ডোবার আগে ঐ ব্যক্তি তার গোয়াল ঘরটি পরিস্কার করে সেখানে একটি পিঁড়ি (বসার জন্য কাঠের মোঁড়া) রাখে। পিঁড়ির চারপাশে গোল করে ঢেলে দেয়া হয় চালের আটা। অতঃপর পিঁড়ির ওপর ধান, দুর্বা ঘাস আর সিঁদুর দিয়ে ভক্তি দিয়ে গবাদিপশুর মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করা হয়।
লবাণঃ
লবাণ বা নবান্ন উৎসব কড়াদের অন্যতম উৎসব। নতুন ধান কাটা উৎসব অনুষ্ঠানের নাম কড়া ভাষায় লবান । জগেন কড়া জানায়, প্রতিবছর অগ্রহায়ণ মাসে প্রত্যেক পরিবারকে পৃথক পৃথকভাবে পালন করতে হয় এই লবান অনুষ্ঠান। আর এ অনুষ্ঠানে সকলে যোগ দেয়। কড়াদের লবানের আনুষ্ঠানিকতাগুলোও বেশ ব্যতিক্রম। যে বাড়ি থেকে যে আরোয়া ধান (নতুন ধান) কাটতে যাবে সে উপোস থাকা অবস্থায় ক্ষেত থেকে কেটে আনবে এক গোছা পাকা ধানের আগাল (ধানের অংশ টা)। আর সে সময় মাথায় করে ধানের গোছা নিয়ে বাড়িতে ঢোকার পূর্বে বাড়ির মহিলারা তাকে প্রণাম করে উলু ধ্বনি দিয়ে তার পা ধুইয়ে দেয়। এরপর দূর্বা ঘাস, প্রদীপ আর ধূপ জ্বালিয়ে বরণ করে মাথার ধান উঠানে নামিয়ে রাখবে। এদের বিশ্বাস এভাবে ফসলরূপী দেবী লক্ষ্মীকে বরণ করা হয়। এরপর ধান থেকে চাল বের করে, ধূপ ও প্রদীপ জ্বালিয়ে বাড়ির তুলসী দেবতাকে ভক্তি করে সেখানে একটি মুরগি বলি দেয়া হয়। কড়া ভাষায় একে পিড়া ঘার বলে। এরপর বলি দেয়া মুরগির মাংসের সঙ্গে নতুন চাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে উপোসকারীর উপোস ভাঙে কড়া’রা। এ ছাড়াও নতুন ধানের কিছু চাল বেটে গোটা বাড়িতে ছিটিয়ে দিতে হয়। এদের বিশ্বাস এতে সারা বছরই বাড়িতে খাদ্যের অভাব হবে না। লবানের সময় এরা একে অপরকে বলতে থাকে, হামনি ঘার আইজ লবান (আমার বাড়িতে আজ লবান্ন)।
তবে বর্তমানে অভাব এবং কড়াদের নিজস্ব ফসলি জমি তেমন একটা না থাকায় দুই একজন ছাড়া এখানকার কড়া সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা বর্তমানে আর লবান পালন করে না। কেননা অধিকাংশ আজ বর্গা চাষী।এক সময় এদের শত শত বিঘা জমি ছিল যার অধিকাংশই চলে গেছে স্থানীয় ভ‚মিদস্যুদের দখলে। ফলে জমির সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে যাচ্ছে একটি জাতির একটি উৎসব। একইভাবে প্রতিবছর কারমা পূজা পালন করলেও আদিবাসী কড়াদের কর্ম ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি অদ্যাবধি। বরং অর্থের অভাবে পূজার উৎসবগুলোও চলছে কোনো রকমে। কারমা পূজার কাহিনীর করমা-ধরমার মতোই কপাল পুড়ে আছে এখানকার আদিবাসীদের। তবুও বুক ভরা আশা নিয়ে প্রতিনিয়ত ভাগ্য জয়ের চেষ্টা চালাচ্ছে কড়া সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা।
মুক্তিযুদ্ধে কড়া’রাঃ
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কড়ারাও দেশ মাতৃকার টানে ঝাপিয়ে পড়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে। তারাও সশস্ত্র সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে আর অংশ নেয় মুক্তিবাহীতে। কড়াদের মধ্যে তিনজন আদিবাসী ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এরা হলেন থোপাল কড়া, সাতান কড়া ও গোপাল কড়া। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শিববাড়ী ইয়ুথ ক্যাম্পে ট্রেনিং নেন এরা। ট্রেনিং শেষে ৭নং সেক্টরের অধীনে কমান্ডার ইদ্রিস আলীর নেতৃত্বে হামজাপুর ক্যাম্প থেকে হিলিসহ নিকটবর্তী গ্রামগুলোকে শত্রু মুক্ত করার জন্য যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরেও এদেশে থোপাল কড়া, সাতান কাড়া’র মতো নিভৃত, বঞ্চিত, ত্যাগী ও অভিমানী মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে পাওয়া যায়। যাদের কোনো কাগুজে সনদ নেই। আছে দেশের জন্য বুকভরা ভালোবাসা। তাই দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে থোপাল কড়া, সাতান কড়াদের মতো মুক্তিযোদ্ধা, আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন এবং তাদেরকে স্বীকৃতি প্রদান করতে না পারলে এর দায় জাতী হিসেবে আমাদেরকে বহন করতে হবে আজীবন। বর্তমান সরকার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে জানিনা নিয়মনীতির বেড়াজাল ভেঙ্গে থোপাল আর সাতান কড়াদের মতো মুক্তিযোদ্ধা আদিবাসীদের ঠাঁই হবে কি না সে তালিকায়।
শেষ কথাঃ
কড়া আদিবাসীদের ভূমি ও পুকুরের পরিমান খুবই সীমিত, যা রয়েছে তার কাগজপত্র/ডকুমেন্ট সংরক্ষণে না থাকায় তা বেশিরভাগ জমি দলিলের মাধ্যমে হাতছাড়া হয়ে গেছে। সহজ সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হলেও ভূমিকে কেন্দ্র করে তাদের নানা ধরনের জটিলতা ও বিরোধের মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অ-আদিবাসীদের দ্বারা আদিবাসীদের জমি আত্মসাতের কারণে ভূমি বিরোধ দেখা দিচ্ছে। ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে আদিবাসীদের এলাকা ছাড়া করার মত ঘটনাও নিরবে নিভৃত ঘটে চলছে প্রতিনিয়ত। এছাড়া আদিবাসীদের নামে সরকারি বরাদ্দকৃত জমি দখলে নিয়ে খাচ্ছে বাঙ্গালিরা যা সংবিধানের ৯৭ ধারার বিধান অনুযায়ী কোনভাবেই সঠিক ও কাম্য নয়। একসময় আদিবাসীরা এসব অন্যায় অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করেছে, কারণ তারা সরকারের আইন কানুন সম্পর্কে জানত না। ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্ত নীতিমালা এবং ১৯৯৮ খ্রীষ্টব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত খাস জমি সংক্রান্ত সংশোধিত গেজেটের মতে ভূমিহীন ব্যক্তিদের খাস জমি বন্দোবস্ত পাবার অধিকার কে সমর্থন দিয়ে তাদের জন্য খাস জমি বরাদ্দ নেওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দেয় এবং তাদের দেখানো পথ অনুসরণ করে এখানকার অনেক ভূমিহীন খাস জমি বরাদ্দ পেয়েছে।
বাংলাদেশের অন্যান্য সকল অঞ্চলের ন্যায় দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ের জনসাধারণ কড়া,সাওতাল, ইসলাম, হিন্দু প্রভৃতি ধর্ম ও গোত্রভিত্তিক কমিউনিটিতে বিভক্ত। এর মধ্যে নিরহ প্রকৃতির কড়া’রা প্রভাবশালী ও ভুমিদস্যুদের দ্বারা শোষিত ও লাঞ্চিত হয় এবং তাদেরকে নাগরিক অধিকার হতে বঞ্চিত করা হয়। আজ কড়া সহ অন্যান্য জনগোষ্ঠি বিভিন্ন ধর্ম ও গোত্রে বিভক্ত হলেও এসব কমিউনিটির সদস্যদের একটি কমন বৈশিষ্ট্য হল তারা সকলেই ভূমিহীন, গরীব ও শোষিত জনগোষ্ঠী অর্থাৎ তারা সকলেই সমরূপী বৈষম্যের শিকার। তাই তাদের চেতনা, অধিকার, চাহিদা ও মূল্যবোধও একই যা মূলত কমিউনিটি সৃষ্টির প্রথম শর্তটি পূরণ করে।
তাই উপরোক্ত আলোচনা এবং জরিপকৃত তথ্যাবলীর আলোকে প্রণিত সমস্যা এবং সমস্যাবলীর কৌশল আলোচনান্তে এ কথা বলা সমীচিন যে, বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের জেলা দিনাজপুরে বসবাসরত বিলুপ্তপ্রায় আদিবাসী কড়াদের জীবনযাপন কৃষি নির্ভর এবং তাদের প্রাথমিক আয়ের উৎস্য কৃষিভিত্তিক। তাদের পৈত্রিক জমি অবৈধভাবে ভূমিদস্যুরা ভোগ দখল করছে দীর্ঘদিন। এসব জমি অতি সত্বর উদ্ধার করে কড়াদের ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা সরকারকেই গ্রহন করতে হবে। কড়াদের সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার জন্য নিতে হবে বাস্তবমূখি পদক্ষেপ। চলমান মামালাসহ তাদের উপর যেন ভূমিদস্যুরা আর কোন অত্যাচার করতে না পারে তার নিশ্চিয়তা নিশ্চিত করতে না পারলে কড়া নামের এই আদিবাসী গোষ্ঠিটি বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে। নতুন প্রজন্মের কড়দের জন্য বিশেষ জীবন ঘনিষ্ঠ দক্ষতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহন করতে হবে। তাদের কৃষ্টি কালচার এবং ঐতিহ্যকে দেশের বহুমাত্রিক সাংস্কৃতির স্বার্থে টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ এখনই গ্রহন করতে হবে।
সরকার এবং বিভিন্ন এনজিওদের প্রকল্পের মাধ্যমে কড়াদের সামান্য আয়ের পথ তৈরী হয়েছে। কিন্তু কড়া পরিবার গুলোর কৃষিজমি না থাকায় এবং অন্য পেশা তাদের জানা না থাকায় বর্তমানে তারা মূলতঃ দারিদ্রতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। তাই কড়া’রা মানবেতর জীবন যাপন করছে, তাইতো আজও কড়া আদিবাসী পরিবার তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত। কবে পাবে ভূমিতে অধিকার সেই প্রত্যাশায় দিন গুনছে কড়া আদিবাসী পরিবারগুলো। যদি আমরা ২০৩০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যেতে চাই, তবে এ সমস্ত অভাবি, হতদরিদ্র, অসহায় এবং ভূমিহীন আদিবাসী মানুষদের নিয়ে কার্যকরী কর্মসূচী গ্রহন ও বাস্তবায়নের এখনেই সময়। এ সমস্ত আদিবাসী মানুষদের বাদ দিয়ে কোন উন্নয়নেই টেকসই হবে না বলে আমার বিশ্বাস। ভ‚মি কেন্দ্রিক বৈষম্য, নানা অবহেলা আর অনটনের মধ্যেও নিজেদের টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে আদিবাসী কড়া’রা।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায় তারা কি পারবে নিজেদের জাত ধর্মকে টিকিয়ে রাখতে? কড়া’রা হারিয়ে গেলে এদেশ থেকে হারিয়ে যাবে একটি জাতি, একটি জাতির ভাষা এবং তাদের সংস্কৃতিক উপাদানগুলো। এদের টিকিয়ে রাখতে তাই প্রয়োজন সরকারি বিশেষ উদ্যোগের। অন্যথায় বাংলাদেশ থেকে নিঃশব্দে ও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে এ কড়া আদিবাসি জাতিটি।
চাষা হাবিব
কবি,গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
তথ্যসূত্রঃ
১. কড়া, সমতলের বিপন্ন আদিবাসী কড়ার জীবনালেখ্য; চাষা হাবিব;
২. আদিবাসী কথা; সালেক খোকন
৩. সরাসরি সাক্ষাতকার গ্রহন; চাষা হাবিব
৪. বাংলা একাডেমীর বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা, দিনাজপুর।
৫. বরেন্দ্রের ইতিহাস – এশিয়াটিক সোসাইটি।
৬. উইকিপিডিয়া, অনলাইন সংস্করণ।
৭. জেলা গেজেটিয়ার দিনাজপুর।
৮. দিনাজপুরের আদিবাসী; মেহেরাব আলী।
৯. স্থাণীয় পত্রিকা; সংখ্যা ১৮, জুন ও ডিসেম্বর ২০১৭; হেরিটেজ, রাজশাহী।
১০. ঈড়ধঃবং, কবহ ঝ. (২০০৪); অ এষড়নধষ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ওহফরমবহড়ঁং চবড়ঢ়ষবং: ঝঃৎঁমমষব ধহফ ঝঁৎারাধষ; ঘবি ণড়ৎশ: চধষমৎধাব গধপগরষষধহ;আইএসবিএন ০-৩৩৩-৯২১৫০-ঢ
১১. “ওহফরমবহড়ঁং রংংঁবং”;ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ডড়ৎশ এৎড়ঁঢ় ড়হ ওহফরমবহড়ঁং অভভধরৎং; ২০০৫
১২. ডএওচ (২০০১০); “ওহফরমবহড়ঁং চবড়ঢ়ষবং ধহফ ঃযব টহরঃবফ ঘধঃরড়হং ঝুংঃবস”; ঙভভরপব ড়ভ ঃযব ঐরময ঈড়সসরংংরড়হবৎ ভড়ৎ ঐঁসধহ জরমযঃং, টহরঃবফ ঘধঃরড়হং ঙভভরপব ধঃ এবহবাধ.
১৩. ইড়ফষবু, ঔড়যহ ঐ (২০০৮).;ঠরপঃরসং ড়ভ চৎড়মৎবংং (৫ঃয. সংস্করণ); চষুসড়ঁঃয, ঊহমষধহফ: অষঃধগরৎধ চৎবংং; আইএসবিএন ০-৭৫৯১-১১৪৮-০;
১৪. ড.ড ঐঁহঃবৎ, অ ঝঃধঃরংঃরপধষ অপপড়ঁহঃ ঙভ ইবহমধষ,ঠড়ষ.ঠরর (খড়হফড়হ;ঞৎঁনহবৎ ্ ঈড়.১৮৭৬, চ.৩৯৭
১৫. মাঠ সমীক্ষা-২০১৫, বিএসডিএ, দিনাজপুর।
১৬. ড. মো. মাহবুবর রহমান, দিনাজপুর জেলার লোকসংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি ১৯৭২-১৯৩১: একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা, শরীফ উদ্দিন আহমদ (সম্পা), দিনাজপুর: ইতিহাস ও ঐতিহ্য (ঢাকা: বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি,১৯৯৬)
১৭. সালেহিন খোকন, সালেহিন খোকন বøগ-কড়া বিষয়ক প্রবন্ধ; সাংবাদিক, লেখক, ঢাকা।
১৮. ড. মাযহারুল ইসলাম তরু, “ওরাওঁ” মেজবাহ কামাল (সম্পা), আদিবাসী জনগোষ্ঠী, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা