আত্মার জাগরণ: স্বামী বিবেকানন্দের কবিতায় মানব ও আধ্যাত্মিক সন্ধান
চাষা হাবিব

এক.
স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) মূলত একজন আধ্যাত্মিক চিন্তাবিদ, বেদান্ত দর্শনের প্রবক্তা ও কর্মযোগের পথপ্রদর্শক। ধর্মীয় গুরু হিসেবে ব্যাপক পরিচিত হলেও কবি হিসেবে তাঁকে আমরা তেমন চিনিনা।তিনি কবিতা, প্রবন্ধ, গান এবং জ্ঞানকথা সৃষ্টির মাধ্যমে তৎকালীন ভারত উপমহাদেশে আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে আবির্ভূত হন। তাঁর সাহিত্য প্রতিভা অনন্য—বিশেষত তাঁর ইংরেজি ভাষায় লেখা কবিতাসমূহ আধ্যাত্মিকতা, মানবতাবাদ, দেশপ্রেম এবং আত্ম-উন্নয়নের বার্তায় সমৃদ্ধ। তাঁর কবিতা একাধারে দার্শনিক, আত্মমুখী এবং বিশ্বজনীন—যেখানে ভারতীয় উপনিষদীয় ভাবনা ও আধুনিক মানবচিন্তার অর্পূব মিলন ঘটেছে মহা দ্যোতনায়। তিনি ধর্মীয় গুরু, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে যেমন প্রভাবশালী, তেমনি কবি হিসেবেও প্রভাববিস্তারী। মূলত ইংরেজি ও সংস্কৃতে কবিতা রচনা করলেও, তাঁর অনেক কবিতা বাংলায় অনুদিত হয়েছে। তাঁর কবিতায় আধ্যাত্মবাদ, দেশপ্রেমবাদ, মানবতাবাদ, এবং আত্ম-উন্নয়নবাদ গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর কবিতা সমূহের মধ্যে বহুল পঠিত ও বিখ্যাত কবিতাসমূহ হলো- `To the Awakened India’, `Peace’, `My Play is Done’, `The Living God’, `The Hymn of Creation’, `Requiescat in Pace’, `Light’, `The Song of the Sannyasin’ প্রভৃতি অন্যতম।
স্বামী বিবেকানন্দের কবিতা বুঝতে হলো তাঁর সময়কে ও তাকে বোঝা দরকার। তিনি যখন লিখছেন ততদিনে প্রায় ১০০ বছরের বেশি সময় ব্রিটিশ গোলামী আমাদের স্বকীয়তা, আত্মমর্যাদাবোধ এবং স্বাধীকারের আকাঙ্ক্ষাকে ভুলন্ডিত করে ভারতীয় তথাকথিত শিক্ষিত সমাজকে করেছে আগাছা, পরনির্ভর এবং মেরুদন্ডহীন অন্তঃসারশূন্য জাতিতে পরিণত। ঠিক সেই সময় স্বামী বিবেকানন্দের আবির্ভাব। হাজার বছরের ভারতীয় ঐতিহ্যের বাতাবরণে তিনি ঘুমিয়ে পড়া ভারতবাসীকে জাগাতেই যেন কবিতায়, গানে, মন্ত্রে, প্রবন্ধে বক্তৃতায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর কবিতাকে বুঝতে এজন্যই ঔপনেশিক সেই সময়কে বুঝতে হবে নচেৎ কবিতার মূল সুরকে বোঝা দুস্কর। তাইতো, তাঁর কবিতায় আমরা একই সঙ্গে দেখি বিপ্লবের সুর আবার একই সঙ্গে দেখি হাজার বছরের ভারতীয় সংস্কারের মিশেল, যা তাকে কবি হিসেবে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। আলোচ্য প্রবন্ধে কবি হিসেবে স্বামী বিবেকানন্দকে আবিস্কারের চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁর উল্লেখিত কবিতা নিয়েই আজকের এই আলোকপাত।
To the Awakened India
১৮৯৮ সালে লেখা এই কবিতায় কবি পরাধীন ভারতবাসীকে জাগ্রত করার আহ্বান জানিয়ে তিনি ভারতের ঘুমন্ত আত্মাকে যেন জাগাতে চেয়েছেন। তিনি বলেন, ভারতের অতীতে যেমন মহান, তেমনি ভবিষ্যতেও মহান হবে— যদি তার সন্তানরা জেগে উঠে নিজের শক্তি উপলব্ধি করে। ভারতের আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা এবং ঐতিহ্যের গৌরব পুনরুদ্ধার করতে ভারতবাসীকে কাব্যিক দ্যোতনায় তিনি আহ্বান করেন। তাই তো কবিতায় আত্মজাগরণমূলক আহ্বান— উঠো, জাগো, এবং লক্ষ্য পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত থেমো না। তিনি বলেন-
‘Arise, O India, forget not thou art born for higher things!’
তিনি এই কবিতার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে ভারতবাসীকে জাগ্রত হওয়ার আহ্বান জানান। তাই তো কবিতায় তিনি বলেন-
Once more awake!
For sleep it was, not death, to bring thee life
Anew, and rest to lotus-eyes for visions
Daring yet. The world in need awaits, O Truth!
No death for thee!
…….
And tell the world —
Awake, arise, and dream no more!
This is the land of dreams, where Karma
মাত্র পঁয়ত্রিশ বছরের এক যুবকের কন্ঠে আমরা শুনে ফেলি ভারতমাতার জেগে ওঠার অমিয় বাণী। কবিতার ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে আত্মপ্রত্ময়ে জেগে ওঠার গান। যে গানেরই চরম বহিঃপ্রকাশ দেখি পরবর্তীতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের কন্ঠে। যেন তিনি কবি স্বামী বিবেকানন্দের যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে ভারতের মুক্তি ও স্বাধীকার আন্দোলনে নিয়োজিত হন কলমযোদ্ধার ভূমিকায়।

Peace
এই কবিতায় স্বামীজি জীবনের বিশৃঙ্খলার মাঝে চিরন্তন শান্তির খোঁজ করেন। তিনি বোঝাতে চান, সত্যিকারের শান্তি আসে আত্মচিন্তা ও ঈশ্বর-প্রেম তথা আধ্যাত্মিক শান্তির সন্ধ্যান থেকে। তিনি বলেন বাহ্যিক জগত নয়, শান্তির উৎস আমাদের ভেতরেই। ১৮৯০ সালে লেখা এই কবিতা যা ঋগ্বেদের ভাবানুবাদও বলা যায়। কবিতায় কবি আত্মশান্তির ছবক শেখাতে গিয়ে বলেন-
‘Peace be unto all. The light of the Self shines in every heart.’
মাত্র ২৭ বছর বয়সের এক তরুণ কবি অশান্ত পৃথিবীর জন্য চির শান্তির খোঁজে কবিতায় বলে চলেন শান্তিময় কাব্যিক পদবাক্য, যা আজও আমাদের বিস্মিত করে, ভাবনায় আলোড়িত করে। তিনি কি অবলীলায় বলে চলেন-
Peace will come when all the world
Shall live as one great brotherhood,
When men shall cease to wage war
And learn the strength of love,
When pride and greed are conquered,
And hate and fear are done away,
Then shall the earth know peace,
And God will smile upon His children.
My Play is Done
এই কবিতাটিতে কবি স্বামী বিবেকানন্দের গভীর বেদনা ও আত্মসমর্পণের ভাষ্য চিত্রিত হয়েছে। আত্মসমর্পণ ও কর্মশেষের অনুভব এই কবিতার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। তিনি বলেন, জীবনের মঞ্চে তাঁর ভূমিকা শেষ— তিনি ঈশ্বরের কাছে ফিরে যেতে চান। তিনি কাব্যিকতায় বলে চলেন জীবনের সার্থকতা আসে যখন মানুষ নিঃস্বার্থভাবে নিজের কর্তব্য শেষ করে। এটি এক দার্শনিক মহা সত্যকে আমাদের সামনে দাঁড় করায়, ফলতঃ কবিতাটি হয়ে ওঠে দার্শনিক জীবনবোধের কিংবা সুফিজমের কবিতা। সম্ভবত এটি তাঁর জীবনের অন্তিম পর্যায়ে অর্থাৎ ১৯০২ সালে লেখা কবিতা। তাইতো মৃত্যুচিন্তা বা পরকাল তাঁর কবিতায় ফুটে ওঠে পরম ব্যঞ্জনায়। বলা যায় ‘My Play is Done’ হলো এক নিঃশব্দ আত্মসমর্পণের কবিতা— যেখানে স্বামী বিবেকানন্দ তার জীবনের পরিপূর্ণতা ঘোষণা করছেন স্বকীয়তায়। তিনি কারও কাছে কিছু দাবি করেননি, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করেননি। বরং তিনি বলেন—
‘I go to return no more.’
এই কবিতা আমাদের শেখায়— জীবন একটি খেলা, মৃত্যু তার নিরব সমাপ্তি, এবং আত্মা তার বিশ্রাম।
‘I have given my all; now, take me back, my Lord.’
আবার কবিতাটিতে মৃত্যুর মুখোমুখি একজন আত্মজ্ঞানী সন্ন্যাসীর ভাবনা প্রকাশ করে। তিনি জানেন তাঁর ভূমিকা শেষ— তাই তো আমরা দেখি ‘My play is done’ যেন জীবনের শেষনাট্য। তিনি বলেন-
My play is done – the play of the eternal child.
I have danced my dance,
I have sung my song,
I have cried my cries,
I have laughed my laughs.
The baby lies still.
Now, I go–
I go to sleep,
I go to rest,
I go to return no more.
স্বামীজি জীবনকে দেখেছেন একটি খেলা বা Divine Play/Leela হিসেবে— যেখানে মানুষ নাচে, গায়, হাসে-কাঁদে, কিন্তু সবই ক্ষণস্থায়ী। ‘Now I go to rest’– এখানে মৃত্যুকে তিনি ভয় না করে শান্ত বিশ্রাম হিসেবে দেখছেন। ‘…return no more’ এই কথায় তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে তাঁর জন্ম-মৃত্যুর চক্র শেষ হয়েছে। তিনি ‘মুক্ত’ হয়েছেন। ‘The baby lies still’— এখানে কবি নিজেকে এক শিশুরূপে কল্পনা করছেন— যা আমাদের নির্জন, নির্লিপ্ত ও একক আত্মার প্রতীক। মৃত্যু নয়, বরং এটি মুক্তির উপলব্ধি। কবিতাটি বার্তা দেয়—জীবন এক লীলা, যার শেষে আসে পরিপূর্ণ বিশ্রাম।
The Living God
কবি স্বামী বিবেকানন্দ এই কবিতায় বলেন, ঈশ্বর মন্দিরে নয়, মানুষের মধ্যে আছেন— বিশেষ করে দরিদ্র, অবহেলিতদের মধ্যে। তাই মানুষের সেবা মানেই ঈশ্বরের উপাসনা। ‘He who serves the poor, serves Me.’
কবিতায় কবি আধ্যাত্ম চর্চায় ঈশ্বরকে খোঁজেন মানুষের মধ্যে— বিশেষত গরিব, শোষিত, নিপীড়িত দরিদ্র মানুষের মধ্যেই তিনি খুঁজেছেন ঈশ্বরের প্রতিরূপ। তাই তো তিনি বলেন-
‘This is the gist of all worship– to be pure and to do good to others’
তিনি আবার বলে চলেন-
I worship not the stone or the statue’s face,
Nor temples built by hands in time or space.
But in the eye of the hungry, the shivering child,
There shines a light, a power undefiled.
The Hymn of Creation
সৃষ্টি এবং স্রষ্টা সম্পর্কিত চিরকালীন মানুষের যে জিজ্ঞাসা তারই কাব্যিকতা এই কবিতা। সৃষ্টির সূচনাকালের রহস্য নিয়ে ১৮৯০-এর দশক রচিত স্বামী বিবেকানন্দের একটি দার্শনিক কবিতা এটি। মাত্র ২৭ বছরের টগবগে যুবক কবি এখানে প্রশ্ন করেন— কিভাবে সৃষ্টি হলো? কে সৃষ্টি করল? সৃষ্টির রহস্যময়তা এই কবিতার মূল প্রতিপাদ্য। এটি মূলত ঋগবেদের ‘নাসদীয় সূক্ত’-এর ভাবানুবাদ। বলা যায় ভাবাশ্রিত কবিতা, যা আমাদের শেখায় প্রকৃতি ও মহাবিশ্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে এবং আত্মার চিরন্তন সত্য উপলব্ধি করতে। তিনি বলেন-
‘Whence all this creation came— He, the Omniscient, knows not’
তিনি আত্মাকে চেনার জন্য কবিতায় বলে চলেন-
Awake, O soul! Arise and see,
The universe’s unity.
In every leaf, in every sea,
The spark of God dwells endlessly
Requiescat in Pace
‘Requiescat in Pace’ অর্থ হলো শান্তিতে বিশ্রাম করো। এটি প্রিয়জনের মৃত্যুর পর তার প্রতি শ্রদ্ধা এবং শান্তি কামনার কবিতা। কবি স্বামী বিবেকানন্দ এখানে মৃত্যুকে শান্তির পরিণতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন— যেখানে আত্মা মুক্ত হয় এবং চিরন্তন শান্তিতে আশ্রয় নেয়। এই কবিতায় বৌদ্ধ দর্শনের নির্বান তত্ত্বের গভীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কবিতায় জীবনকে যুদ্ধ বা সংগ্রামের মত করে দেখানো হয়েছে, যা শেষ হলে শান্তি আসে। তবে তিনি বোঝাতে চান, মৃত্যু কোনো শেষ নয়, বরং মুক্তির শুরু। এটি ব্রহ্মবাদী দর্শনের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে আত্মাকে চিরন্তন এবং অবিনশ্বর ধরা হয়। সরল ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় রচিত কবিতাটিতে কিছু শব্দের পুনরাবৃত্তি কবিতাটির গম্ভীরতা ও মাধুর্য বাড়িয়েছে। কবিতাটি মৃত্যু ও জীবন সম্পর্কে দার্শনিক চিন্তা করতে শেখায়, শেখায় মানুষের প্রতি করুণা ও শ্রদ্ধার শিক্ষা। সহজ অথচ গভীর অর্থদ্যোতনার কবিতা ‘জবয়ঁরবংপধঃ রহ চধপব’ আমাদের শেখায় মৃত্যুতে ভয়ের কিছু নেই, বরং সেটি একটি চির শান্তির জন্য প্রস্থান, যা ইসলামিক সুফিজমেরও মূল সুর।
‘The soul is free— its wings spread wide
… Where endless peace and sunlight lies’
আবার কবি বলছেন-
Requiescat in pace —
Rest, my brother, rest!
The battle’s done, the war is past,
The toilsome day is o’er at last,
And thou hast gained thy haven at last.
Light
এই কবিতায় কবি আলোর প্রতীক হিসেবে জ্ঞানকে চিত্রিত করেছেন। তিনি কবিতায় ব্রহ্মা-, সৃষ্টি ও মহাশূন্য নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেছেন, যা ঋগবেদের ভাবানুবাদও বটে। সেই অর্থে এই কবিতাটি একটি ভাবানুবাদ কবিতা বলাই শ্রেয়। তিনি কবিতায় বলছেন-
The sun has sunk behind the golden clouds,
The darkness falls like heavy shrouds;
The world is still—
And the hush of night is on hill and rill.
But lo!—what light through zonder darkness breaks?
It is the soul that from slumber wakes!
No sun, no moon, no lamp have lit—
The Light within doth brightly flit.
Not from without, but from the soul,
Comes the Light that makes the spirit whole.
Shine on, O Light, eternal and bright—
Guide us forever through ignorance’s night.
The Song of the Sannyasin
এই কবিতাটি ১৮৯৫ সালে কবি স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকা ও ইউরোপে হিন্দু দর্শন ও বেদান্ত প্রচারে যখন ব্যস্ত তখন তাঁর আধ্যাত্মিক উপলব্ধির প্রতিফলন হিসেবে রচনা করেন। যেখানে তিনি একজন আদর্শ সন্ন্যাসীর চরিত্রচিত্রণ করেন— যিনি নির্ভীক, নির্লিপ্ত, দয়ালু এবং আত্ম-সচেতন। এটি তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা, যার প্রতিটি স্তবকে আত্মত্যাগ, বৈরাগ্য ও সাধনার প্রতিচ্ছবি চিত্রিত। এই কবিতার আত্ম-জ্ঞান ও আত্ম-সচেতনতা (Self-realization)— ‘তুমি আত্মা, তুমি ব্রহ্ম’ মূল কথা। কবি আত্ম-সত্ত্বার মধ্যে ঈশ্বরকে উপলব্ধির কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘Stand thou in That and say, I am That’— এটি উপনিষদের ‘Aham Brahmasmi’ ভাবনার ছায়া বহন করে। যেন কোরআনের ‘ইকরা বিছমি রাব্বিকাল্লাযী খালাক— পড় তোমার প্রভুর নামে’ আয়াতের বহিঃপ্রকাশ।
সন্ন্যাসীর আদর্শ হলো ত্যাগ ও নির্লিপ্তি (Renunciation and Detachment)— কাম, লোভ, পরিবার, খ্যাতি, এমনকি স্বর্গ বা নরকের প্রত্যাশাও ত্যাগ করতে হবে বলে তিনি মনে করতেন। এই নির্লিপ্ততা সন্ন্যাসীর মুক্তির পথ। কবি তাই তো বলেন-
‘Let nothing bind thee: No hope, no name, no fame…’
বিবেকানন্দ সন্ন্যাসীকে সাহসী ও ভীতিহীন হওয়ার আহ্বান জানান। সত্য মানে শুধু বস্তুর সত্য নয়, বরং আত্মার চরম সত্য— ব্রহ্মজ্ঞান। পূর্বেই বলেছি এটি তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক কবিতাগুলোর মধ্যে একটি, যা বিশ্বমঞ্চে ভারতীয় সন্ন্যাস ধর্মের গৌরব তুলে ধরেছে। এটি শুধু সন্ন্যাসীদের জন্য নয়, বরং সকল মানুষের জন্য— যারা মুক্তির পথ খুঁজছেন, বা আত্মশক্তিতে বিশ্বাসী। এই কবিতা অনেক বিপ্লবী, সাধক ও সমাজসেবীকে প্রভাবিত করেছে— যারা জীবনকে নিঃস্বার্থভাবে উৎসর্গ করেছেন। এটি কেবল একটি কবিতা নয়— এটি এক আধ্যাত্মিক ঘোষণাপত্র। এটি সাহস, ত্যাগ, নির্লিপ্তি ও প্রেমের পথনির্দেশ। এই কবিতার মাধ্যমে কবি আত্ম-সাধনার দর্শনকে বিশ্বজনীন করে তুলেছেন। একজন সন্ন্যাসী তাঁর দৃষ্টিতে শুধু গৃহত্যাগী নয়— তিনি একজন মুক্তচেতা, মানবপ্রেমী, এবং চরম সত্যসন্ধানী। তিনি এই কবিতায় বলেন-
‘Be bold, and face the truth!’
কবি স্বামী বিবেকানন্দের মতে, প্রকৃত সন্ন্যাসী সকল জীবের মঙ্গল কামনা করে, যা সার্বজনীন প্রেম ও সেবা (Universal Love and Service), এটি তাঁর ‘Narayan-seva’ ভাবনার প্রতিফলন। কবিতায় তিনি বলেন:
‘Peace to all: From me no danger be to aught that lives’
তার এ কবিতায় সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে আত্মচিন্তা ও আত্ম-সাধনা। তিনি মানুষের আত্মাকে ঈশ্বরের অংশ হিসেবে দেখেছেন। তিনি বলেন—
‘I am He, I am He, Blessed Spirit, I am He!’
তিনি বারবার বলেন, কামনা, ভয়, লোভ, খ্যাতির মোহ— এসব ত্যাগ করতে হবে। এটি সন্ন্যাস ধর্মের মূল শিক্ষা এবং তার কবিতার অন্যতম বার্তা। তিনি কাব্যিকতায় বলে চলেন-
‘Wake up the note! the song that had its birth’
Far off, where worldly taint could never reach,
In mountain caves, and glades of forest deep,
Whose calm no sigh for lust or wealth could break,
Where rolled the stream of knowledge, truth, and bliss—
That brings a glory to this human life.
As, break, break the lust of body, break the chain
Of flesh and bones in the mind; stand up,
Say, ’I am the Soul’, the Soul that ever lives.
Leave form, and seek the formless;
Seek thou the unmanifested, the eternal.
No more is birth, nor I, nor thou, nor God,
Nor man, nor the condition of the mind.
Know thou art That, Sannyasin bold!
Say— ’Om Tat Sat,’ Om!

দুই.
সাধক কবি স্বামী বিবেকানন্দের উপরোক্ত আলোচিত কবিতাসমূহের আলোকে আমার বলতে পারি, তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো আধ্যাত্মিকতা, আত্মবিশ্বাস, মানবতাবাদ, ভাষার সরলতা, দর্শন ও ভাবনা। তাঁর কবিতা বেদান্ত, উপনিষদ ও ঈশ্বর ভাবনায় পূর্ণ, যা কখনো কখনো কাব্যিক ভাবানুবাদ হিসেবে ধরা যায়। তাঁর কবিতায় সাহস ও আত্মবিশ্বাস বারবার উচ্চারিত হয়েছে যেখানে দরিদ্র, শোষিত ও সাধারণ মানুষের প্রতি দয়া এবং শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি কবিতায় খুব সহজ ইংরেজি ব্যবহার করেছেন— কিন্তু ভাব গভীর ও প্রাঞ্জল। তাঁর কবিতা পড়লে মনে হয় যেন আমরা এক ঋষির বাণী শুনছি।
তাঁর সব কবিতাই ইংরেজিতে লেখা হলেও তা ভারতীয় ভাবধারায় ভরপুর। তিনি কেন ইংরেজিতে লিখেছেন সেই প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা পরের কোন উপলক্ষের জন্য রাখা হলো। স্বামী বিবেকানন্দের বেশিরভাগ কবিতা গদ্যছন্দে (free verse) লিখিত হলেও মুক্তছন্দের ব্যবহারও আমরা লক্ষ্য করি, যা আধুনিক কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর কবিতায় ‘I am That’, ‘Thou art That’, ‘Self,’ ‘Maya’, ‘Brahman’— প্রভৃতি উপনিষদের শব্দবিন্যাস চরমভাবে লক্ষ্যণীয়, যেখানে প্রকৃতির বর্ণনার চেয়ে আধ্যাত্মিক ভাবনা ও অন্তর্মুখিতাই বেশি মাত্রায় ব্যবহৃত। কবিতায় আমরা দেখি ‘I have…’ I, ’I go…’ এরূপ শব্দবন্ধ বারবার ব্যবহার করেছেন, কবি গভীর অর্থে। আবার গীতিময়তা বাড়াতে ‘baby’, ‘play’, ‘sleep’— এসব শব্দ ও প্রতীক ব্যবহার করেছেন জীবনের পরিণতি বোঝাতে যথেষ্ঠ মুন্সিয়ানার সাথে, ফলে কবিতাগুলো বাড়তি পক্ষপাতের দাবি রাখে।
স্বামী বিবেকানন্দের কবিতা আমাদের শুধুই কবিতা শেখায় না, বরং শেখায়—কিভাবে নিজের ভেতরের শক্তি জাগাতে হয়, কিভাবে সত্যের পথে চলতে হয়, কিভাবে দেশকে ভালোবাসতে হয়, আর কিভাবে সকল মানুষের সেবা করাকেই ঈশ্বরসেবা হিসেবে মানতে হয়। তাঁর কবিতা অনুপ্রেরণাদায়ক, দর্শন ও সাহিত্য দুইয়ের সমন্বয় সাধন করে। যা, নৈতিক ও আত্মিক শিক্ষায় আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। তাঁর কবিতা কেবল কবিতা নয়, বরং একাধারে একটি জীবনদর্শন, একটি আত্মজাগরণের ডাক। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর কবিতার মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছেন— সত্যিকারের স্বাধীনতা আসে যখন আমরা ভয়ের শিকল ভেঙে আত্মাকে চিনতে পারি। তাঁর কবিতা যুগে যুগে পাঠককে দিশা দেখিয়েছে, দেখাচ্ছে এবং দেখাবে।
স্বামী বিবেকানন্দের কবিতা কেবল সাহিত্য নয়— তা এক ধরনের আধ্যাত্মিক সাধনা, মননের চর্চা। তাঁর কবিতাগুলো আমাদের শেখায় কিভাবে জীবনের গভীরতর সত্য উপলব্ধি করতে হয়, কিভাবে মানবজীবনকে বৃহত্তর লক্ষ্যের সঙ্গে যুক্ত করতে হয়, এবং কিভাবে আত্মবিশ্বাস ও ত্যাগের পথে চলতে হয়। যদিও তাঁর কবিতাকে অনেকে ধর্মীয় কবিতা বলে থাকেন। তবে, এ কথা দ্যর্থহীনভাবেই বলা যায়, তাঁর কবিতা ধর্মীয় নয়, বরং মুক্তির কবিতা— যা ধর্ম, জাতি, সময় ও ভাষা অতিক্রম করে মানুষের অন্তরকে জাগিয়ে তোলে এবং এখনো তুলছে।
কবি স্বামী বিবেকানন্দ উপনিষদের ‘অহম্ ব্রহ্মাস্মি’, ‘তত্ত্বমসি’ ইত্যাদি মূল বাণীকে তাঁর কবিতায় আধুনিকভাবে কাব্যিক রূপ দিয়েছেন। আত্মা ও ঈশ্বর এক, এ নিয়ে তিনি কবিতায় বলেন- ‘I am He’— অর্থাৎ আমি সেই ব্রহ্ম। তিনি বলেন দ্বৈততা ত্যাগ করো অর্থাৎ ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ— এসব দ্বৈতবোধ আত্মজ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে। তিনি সার্বজনীন মানবিক বার্তা হিসেবে কবিতায় মানবতার জয়গান গেয়ে বলেন- ‘সকলের জন্য শান্তি হোক’। তাই তো তাঁর কাব্যিক বার্তা আজও সমান প্রাসঙ্গিক: আমরা যখন আত্মবিশ্বাস হারাই, তখন এটি মনে করিয়ে দেয়—‘Be bold!’; আবার যখন সমাজ ভেঙে পড়ে, তখন এটি বলে — ‘Peace to all’; আবার আমরা যখন মোহে পড়ে যাই, তখন এটি শেখায় — ‘Freedom lies within’; এভাবেই তাঁর কবিতা আলোকবর্তিকা হয়ে আমাদের নিয়ে যায় আত্ম পরিচয়ের চরমতম উদ্ভাসিত আলোকে।

শেষ কথা
স্বামী বিবেকানন্দকে আমরা কবি হিসেবে সেই অর্থে খুব বেশি চেনার চেষ্টা করিনি। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক কবি তিনি। মাত্র ৩৯ বছর বেঁচে ছিলেন। এই অল্প সময়েই তিনি কবি, চিন্তক, দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক ও ধর্মীয় গুরু হিসেবে কাজ করে নিজেকে চরম শ্রদ্ধেয় স্বাামীজিতে পরিণত করেছেন। তাঁকে আমরা আধুনিক কবি হিসেবে মূল্যায়িত করতেই পারি। তাঁর অমর বাণী ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’ আমাদের কাছে বেদবাক্যের মতো পবিত্র হয়ে উঠেছে। যদিও আধুনিক কবি ও কবিতা নিয়ে রয়েছে বিস্তর ডিসকোর্স মাতাদর্শ। বলা হয়, আধুনিক কবিতা ঠিক কৃষ্ণ গহবরের মতো রহস্যে ঘেরা জটিল, যার বহুমাত্রিক ব্যাপ্তি কবিতাকে করেছ বহুধা ধারায় বিভক্ত। কবিতা কি এ নিয়ে রয়েছে বিস্তর আলোচনা, সমালোচনা এবং মতাদর্শ। আমি বলি হৃদয় তরঙ্গের ছোঁয়ায় আঁকা শাব্দিক এবং শৈল্পিক আল্পনাই কবিতা। কবিতা নদীর ঢেউয়ের মতো গতিময়, অনন্ত। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মাতরে বহমান। কবিতায় চূড়ান্ত বলে কিছু হয় না। সর্বজনগ্রাহ্য কবিতার সংজ্ঞা পাওয়া সত্যিই কঠিন। বিভিন্নজনের কাছে কবিতা বিভিন্ন রকম, বোধের পার্থক্যও স্পষ্ট—এটাই বাস্তবতা; আর এজন্যই কবিতা নিরন্তর সৌন্দর্য সাধনার অনিঃশেষ খোরাক। সময়ের ব্যবধানে, জাগতিক বৈচিত্র্যে, বাস্তবতা ও পরিবেশের রকম ফেরে কবিতা নানাবিধ ডালপালা মেলে যেন রহস্যবৃক্ষ। সৌন্দর্য সম্পর্কে যেমন চূড়ান্ত কিছু হয় না, কবিতা সম্পর্কেও ঠিক শেষ কথা বলা যায় না। সময় যেমন পরিবর্তনশীল, সময়ের সাথে সাথে কবিমন, কবিতা, কবিতার ভাষা, শব্দচয়ন, অঙ্গসৌষ্ঠব ও ভাবের বিন্যাসও তেমন পরিবর্তশীল। কবিতা কখনোই আধুনিক, পুনরাধুনিক বা উত্তরাধুনিক হয় না। আধুনিক বা পুনরাধুনিক হয় কবিতার ভাষা, তার শব্দগঠন ও বিষয়ানুযায়ী সময়ের প্রেক্ষাপট। এ বিবেচনায় কবি স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর নিজস্ব কাব্য ভাষাশৈলি তৈরি করতে পেরেছেন- এ কথা বলাই বাহুল্য।
আবার বলা হয়ে থাকে, যে কোনো স্তরের শিল্পকর্ম বা সাহিত্যকর্ম কিংবা যে কোনো পর্যায়ের শিল্পীর জন্যে অপরিহার্য কর্তব্য হচ্ছে নিজের শ্রেণিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং নিজেকে নিজের লোকালয়ের জনগণের সাথে মিশিয়ে ফেলা; তবে এই মিশ্রণের সময় শিল্পীকে আবশ্যিকভাবে স্মরণ রাখতে হয় সময় ও বাস্তবতাকে, স্মরণ রাখতে হয় শিল্পীর মস্তিস্ক্যের সক্ষমতাকে, নিজের সেরেব্রাল কোটেক্টকে। কারণ মনে রাখতে না পারলে বড় ভুলে তিনি ভুলেই যান যে, তিনি তার জনতারই অংশমাত্র। ফলে শিল্পী মনের অজান্তেই সরে যান মূল থেকে। এ কথা প্রণিধানযোগ্য যে, জনাংশের ভগ্নাংশ হতে না পারলে একজন মননশীল ব্যক্তি, শিল্পী বা সাহিত্যিক তাঁর সাবলিমিটির চূড়াকে স্পর্শ করতে পারেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্পর্শ তো দূরের কথা অনুভূতির এককও নির্মাণ করতে পারেন না। ফলে তা নিতান্তই হৃদকথায় পরিণত হয়। এখানেই কবি স্বামী বিবেকানন্দ কবি হিসেবে অনন্য এক সত্ত্বা। এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, একজন শিল্পীকে যাবতীয় হঠকারীতা এবং সুবিধাবাদ হতে যোজন-ফ্যাদম দূরে অবস্থান করতে হয় এবং করা উচিত, না হলে আত্মমগ্নতা এবং বাস্তবতার মাঝে সৃষ্ট হয় কিংবা ধরে ভয়াবহ ফাটল। আর এ ফাটল শিল্পীকে ধ্বংস করে, কারণ রচনা নির্মাণকালীন সময়ে শিল্পীর কাছে আত্মমগ্নতাই প্রবল হয়ে ওঠে। এই আত্মমগ্নতার সময়ই হলো তার নির্মাণের উপযুক্ত সময়। এই সময় তার জ্ঞান বাস্তুচ্যুত হলেই সর্বনাশ, যেমনটা আমরা অহরহ দেখছি। এক্ষেত্রে নিংসন্দেহে কবি স্বামী বিবেকানন্দ যথার্থ করেই নির্মাণ করেছেন তার কবিতা। তিনি পতিত সময়ে জাতির দুর্দিনে জেগে উঠার জন্যই লিখেছেন কবিতা, গান, প্রবন্ধ সহ আরও অনেক কিছু। যা, কবিকে সাবলিমিটির চূড়া স্পর্শ করতে সহায়তা করেছে। চলতে চলতে আমরা চলার পথকে চিনতে পারি, চলার পথকে আবিষ্কার করি। আবার নিজের চলার পথকেও নির্মাণ করতে পারি। এই নির্মাণে যুগ যুগ ধরে স্বামী বিবেকানন্দের কবিতা আমাদেরকে করেছে আত্ম সচেতন ও আত্মপরিচয়ে পরিচিত।
জয় হোক কবিতার, জয় হোক মানবতার, জয়তু কবি স্বামী বিবেকানন্দ ॥
চাষা হাবিব
কবি ও গবেষক
সম্পাদক- বাহে’ সাহিত্যপত্রিকা।